ইসলামী শরী’য়ার দৃষ্টিতে উশরের বিধান ও বাংলাদেশের ভূমি
- আপডেট সময়- ১১:২৭:০৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৩ বার পড়া হয়েছে
মোঃ ফেরদৌস আলম।।
আল্লাহ তা’আলা মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। আর পৃথিবীকে করেছেন মানুষের জন্য বসবাস উপযোগী আবাস। যমীনকে করেছেন মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস। আর তাতে দিয়েছেন নানাবিধ ফল-ফলাদি ও ফসল। এসব ফলফলাদি ও ফসলের উপর ওশর কে করেছেন যাকাতের ন্যায় ফরজ। যা মুসলিম হিসেবে যথাযথ পদ্ধতিতে পালন করা আবশ্যক।
যেমন আল্লাহ বলেছেন, তিনি (আল্লাহ) যিনি লতাগুল্ম বিশিষ্ট আর লতা-বিশিষ্ট নয় এমন উদ্যানরাজি, খেজুর গাছ ও বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য, একই ধরনের ও আলাদা ধরনের যায়তুন ও ডালিম সৃষ্টি করেছেন। যখন ফল ধরে তখন ফল খাও, আর ফসল তোলার দিন (নির্ধারিত উশর ও অনির্ধারিত দানের মাধ্যমে) হক আদায় কর, অপচয় করো না, নিশ্চয় তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা আনআম, আয়াত : ১৪১)
তিনি আরো বলেছেন, ‘মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুক, আমি প্রচুর পানি বর্ষণ করেছি, এরপর ভূমিকে বিদীর্ণ করে দেই, অতঃপর তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙ্গুর, শাক-সবজি, যয়তুন, খেজুর, ঘন উদ্যান, আর নানান জাতের ফল আর ঘাস-লতাপাতা, তোমাদের ও তোমাদের চতুষ্পদ জন্তুদের উপকারার্থে’ (আবাসা ৮০/২৪-৩২)।
উশর মূলত কি?
আরবী আসারা শব্দ থেকে উশর শব্দটির উৎপত্তি। আরবী ভাষায় আশারা শব্দের অর্থ দশ, আর উশরুন শব্দের অর্থ দশ ভাগের একভাগ। উশর হলো জমি থেকে উৎপন্ন ফসল ফলাদির যাকাত।
উশরী জমিনে উৎপাদিত শস্যের এক দশমাংস বা তার অর্ধেক গ্রহণ করাকে উশর বলা হয়।
যদি আল্লাহর দেয়া প্রাকৃতিক পানি দ্বারা জমি আবাদ করে, তাহলে এক দশমাংশ, আর যদি নিজস্ব পানি দ্বারা আবাদ করে, তাহলে নিসফে উশর তথা বিশ ভাগের একভাগ দান করবে।
উশরী ভূমি কি? কোন জমিতে উশর দেয়া আবশ্যক?
১. কোনো জমিনের মালিকেরা স্বেচ্ছায় মুসলমান হয়ে গেলে তাদের ভূমি উশরী হয়ে যাবে।
২. মুসলিম সেনাপতি কোনো কাফের রাষ্ট্র বিজয়ের পর সে এলাকার জমি মুসলমানদের মাঝে বন্টন করে দিলে।
৩. কোনো অনাবাদী জমি মুসলমান আবাদ করলে তার পাশের জমি ওশরী থাকলে তাও উশরী বলে সাব্যস্ত হবে।
৩. মুসলমান থেকে ওশরী জমি কিনলে তা উশরী হিসেবেই বাকি থাকবে।
৪. যে ভূমির অবস্থা জানা নেই তাও উশরী বলে ধর্তব্য হবে।
কোন কোন ফসল থেকে উশর দিতে হবে?
কোনো ফসলে উশর আসবে এ ক্ষেত্রে কুরআনের ভাষায় কর্তিত ফসল এবং জমীন থেকে যা উৎপন্ন হয় তার কথা বলেছেন। ঠিক হাদীসেও একই কথা এসেছে।
এ ক্ষেত্রে যা উৎপাদিত প্রয়োজনীয় মূল্যবান সামগ্রী তাতে উশর আসবে, অন্য কিছুতে নয়। সে হিসেবে ধান, পাট, গম, আলুসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কাচা মাল ইত্যাদি, এমনকি যে বাঁশ ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে উৎপন্ন করা হয়, তাতেও উশর আসবে।
ইমাম আবু হানীফার মতে ইচ্ছাকৃতভাবে উৎপাদন করা হয় এবং একেবারেই মূল্যহীন ও বেচাকেনার অযোগ্য নয় এমন যে কোন কৃষিজাত দ্রব্যের উশর দিতে হবে।
অন্য কতিপয় ফকীহ ও মুহাদ্দিস কয়েকটি নির্দিষ্ট কৃষিজাত দ্রব্যের ওপর বিশেষ শর্ত ও গুণাগুণ সাপেক্ষে উশর দেয়া বাধ্যতামূলক বলে রায় দিয়েছেন। যেমন, তা খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া চাই এবং শুকিয়ে গুদামজাত করা যায় এমন হওয়া চাই। তারা দলীল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, “হে ঈমানদারগণ! যে সম্পদ তোমরা উপার্জন করেছ এবং যে সম্পদ আমি তোমাদের জন্য মাটি থেকে উদগত করেছি, তার মধ্য থেকে উত্তম অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় কর।”
মূসা ইবনু ত্বালহা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক মু’আয (রাঃ)- এর নিকট প্রেরিত পত্র আমাদের নিকট ছিল। যাতে তিনি গম, যব, কিসমিস ও খেজুরের যাকাত(উশর) গ্রহণ করেছেন।
উল্লিখিত হাদীছয়ে বর্ণিত চারটি শস্যের যাকাতের কথা বলা হলেও এই চারটিকেই নির্দিষ্ট করা হয়নি। বরং ওযন ও গুদামজাত সম্ভব সকল শস্যই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন ধান, ভুট্টা ইত্যাদি।
অতএব গুদামজাত অসম্ভব এমন শস্যের যাকাত ফরয নয়। যেমন শাক-সবজি বা কাঁচা মালের কোন যাকাত (উশর) নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘শাক-সব্জিতে কোন যাকাত (ওশর) নেই’।
উল্লেখ্য যে, এ জাতীয় সম্পদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ এক বছর অতিক্রম করলে এবং নিসাব পরিমাণ হলে শতকরা ২.৫০ টাকা হারে যাকাত দিতে হবে।
আহলে ইলমরা এ ব্যাপারে একমত যে, নিশ্চয়ই গম, যব, খেজুর ও কিশমিশে সদকা (উশর) ওয়াজিব।
উশর এর নিসাব বা পরিমাণ কি?
উশর এর নিসাব আছে কী নেই, এ ব্যাপারে দুটি মত আছে। ইমাম আবু হানিফা রহ. এর মতে উশর ফরয হবার জন্য নির্ধারিত কোনো নিসাব নেই। দলীল হলো, নবীজী স. এর হাদীস ও পবিত্র কুরআনের আয়াতের আম বর্ণনা কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করছে না। আর এতে গরীবদের উপকারও রয়েছে। তাই উশর ফরয হবার জন্য কোনো পরিমাণ নেই। যেমনটি বলা হয়েছে হিদায়ায়-, জমীনে কম বেশি যা-ই উৎপাদিত হবে, তাতে উশর আসবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘বৃষ্টি ও ঝর্ণার পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা নালার পানিতে উৎপন্ন ফসলের উপর ‘ উশর’ (দশ ভাগের এক ভাগ) ওয়াজিব। আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের উপর ‘অর্ধ উশর’ (বিশ ভাগের এক ভাগ) ওয়াজিব’।(বুখারী হা/১৪৮৩, মিশকাত হা/ ১৭৯৭)
অধিকাংশ ইমামের মতে উশরের নিসাব হচ্ছে -“পাঁচ ওয়াসাক”। জমির ফসলের পরিমান “পাঁচ ওয়াসাক” হলে তার উশর আদায় করতে হবে। আর তা ফসল মাড়ায়ের দিন উশর হিসেবে বের করে দিতে হবে।
উল্লেখ্য যে, ১ ওয়াসাক সমান ৬০ ছা। অতএব ৫ ওয়াসাক সমান ৬০*৫=৩০০ ছা। ১ ছা সমান ২ কেজি ৫০০ গ্রাম হলে ৩০০ ছা সমান ৭৫০ কেজি হয়। অর্থাৎ ১৮ মণ ৩০ কেজি। এই পরিমাণ শস্য বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত হলে ১০ ভাগের ১ ভাগ উশর ফরজ। আর নিজে পানি সেচ দিয়ে উৎপাদন করলে ২০ ভাগের ১ ভাগ ওশর ফরজ।
এখন প্রশ্ন হতে পারে উশর খরচ বাদ দিয়ে নাকি খরচসহ দশমাংশ দিতে হবে?
ফসল করতে যা খরচ হয়েছে সেসব খরচ বাদ দিয়ে হিসেব করা যাবে না বরং জমিতে যতটুকু ফসল হয়েছে, যতটুকু উৎপাদিত হয়েছে তার মাঝে এক দশমাংশ দান করে দিতে হবে। এটাই বিধান। কর্মচারীর বেতন,গাড়ি ভাড়া কিংবা অন্যান্য খরচের জন্য ফসলের মূল্য বা ফসল বাদ দিয়ে দশমাংশ গণনা করা যাবে না বরং যা’ই উৎপন্ন হয় তার মধ্য থেকে এক দশমাংশ বা বিশ ভাগের একভাগ দান করতে হবে।
উশরের শরয়ী বিধান কি?
কুরআন ও হাদীসের দলীলের ভিত্তিতে সুস্পষ্টভাবে জানা যায় যে, উশরী ভূমি থেকে উশর আদায় করা ফরয। যেমন যাকাত আদায় করা ফরয।
এ ব্যাপারে কুরআনের দলীল হল- আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, “কর্তনের দিবসেই এর হক আদায় করে দাও।
ইবনে আব্বাস রা. বলেন, হকটি হলো ফরজ। আবার বলেন,এ হক হলো উশর ও নিসফে উশর ।
বাংলাদেশের ভূমি উশরী না খারাজী?
বাংলাদেশের ভূমি উশরী না খারাজী এ ব্যাপারে একদল ওলামা বলেন খারাজী। তাদের যুক্তি হলো, বাংলাদেশ ছিল পৌত্তলিকদের দেশ। এখানে সর্বপ্রথম মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান কুতুবুদ্দীন আইবেক এর সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজী ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা বিজয় করেন। বিজয়ের পর তিনি বাংলাদেশের ভূমি মুসলমানদের মাঝে গণিমতের মাল হিসেবে বন্টন করেছিলেন কিনা একথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
তবে স্বাভাবিক যুক্তিতে এ কথাই বুঝে আসে যে, এ বিশাল বাংলা যেমন পূর্বে হিন্দুদের হাতে ছিল, এমন জমিন ছিল রাষ্ট্রের অধীন, তেমনি রেখে দিয়েছিলেন বখতিয়ার খিলজী। তাদের সাথে খারাজের চুক্তি সাধন করেন, উশরের নয়। কারণ ওশর কাফেরদের সাথে হয় না। যা তার নিযুক্ত গভর্নরের মাধ্যমে মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান পর্যন্ত পৌঁছত। আর আমরা জানি, মুসলিম বাহিনী কর্তৃক বিজিত এলাকা মুসলমানদের মাঝে বন্টন না করলে তা খারাজী ভূমি হিসেবেই বাকি থাকে। আর যে ভূমিতে একবার খারাজ সাব্যস্ত হয়, তা চিরকাল খারাজীই থাকে। সুতরাং, এ সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায় যে, বাংলাদেশের ভূমি খারাজী। উশরী নয়। (ইসলামী অর্থনীতির আধুনিক রূপায়ন)
অপর দিকে ঐতিহাসিক গণ এ কথাই প্রমাণ করছে যে, বখতিয়ার খিলজী এ দেশে আসার পূর্বেই বাংলাদেশে প্রচুর মুসলমান ছিল। আর এ কথাও ঐতিহাসিক সত্য যে, আগত মুসলিম মনীষীদের ব্যাপক হাদিয়া তোহফা দিত এদেশের সাধারণ জনগণ। সুতরাং কয়েকটি সঙ্গত কারণ বিবেচনা করে আমাদের দেশের ভূমি উশরী, খারাজী নয়, বলেই সাব্যস্ত হয়।
ঐতিহাসিক বর্ণনা দ্বারা জানা যায় যে, খৃষ্টীয় সপ্তম শতকে হযরত ওমর রা. এর শাসনামলে কয়েক জন ধর্ম প্রচারক হযরত মামুন ও হযরত মুহাইমিনের নেতৃত্বে এ দেশে আগমন করেন। দ্বিতীয় বার হযরত হামেদুদ্দীন মুর্তজা, আব্দুল্লাহ ও আবু তালেব রহ. ইসলামের প্রচার অভিযানে এ দেশে আগমন করেন। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে খলীফার নামাঙ্কিত মোহর প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যে পাওয়া যাওয়ায় গবেষকগণ মনে করেন যে, সে সময় হয়তো এ দেশে মুসলিম বণিকদের সমাগম হয়েছিল। এরপর ৮৭৪ খৃষ্টাব্দে হযরত বাইজিদ বোস্তামী চট্টগ্রামে, ১০৪৭ খৃষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ মাহীসাওয়ার বগুড়ার মহাস্থানগড়ে, শাহ মুহাম্মদ সুলতান রুমী ১০৫৩ খৃষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা এলাকায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমণ করেন।
খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বল্লাল সেনের শাসনামলে বাবা আদম শহীদ র. এদেশে ইসলাম প্রচারে নিয়োজিত ছিলেন বলে জানা যায়। এ শতাব্দীতে হযরত ফরীদ উদ্দীন গঞ্জে শকর (১১৭৭-১২৬৯ ইং) চট্টগ্রামে, হযরত শাহ মাখদুম রূপোস (১১৮৪ ইং) রাজশাহীতে ব্যাপক ভাবে ইসলাম প্রচার করেন। (হাদীস শাস্ত্র ও তার ক্রম বিকাশ)
বখতিয়ার খিলজীর ১২০৪ খৃষ্টাব্দের বাংলা বিজয়ের পূর্বেই প্রচুর পরিমাণ মুসলিম মনীষীদের সাহচর্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানদের ভূমিকে খারাজী বলে সাব্যস্ত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। বরং তা উশরী হিসেবেই ছিল। সেই ভূমি কতখানি বা কতগুলি তা জানা নেই। কিন্তু তাদের ভূমি যে উশরী ছিল এটা নিশ্চিত। কিন্তু বাকি হিন্দুদের অধিকৃত ভূমি খিলজী ভাগ করে দিয়েছিলেন কিনা তা নিশ্চিত নয়। ঠিক তেমনি পূর্ব অবস্থায় বহাল রেখেছেন কিনা, তারও কোনো সুনির্দিষ্ট ভিত্তি নেই। তবে পূর্ব অবস্থায় রেখেছেন বলেই মনে হয়। কিন্তু মনে হওয়া এক জিনিস আর নিশ্চিত হওয়া ভিন্ন জিনিস।
সুতরাং সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের ভূমি খারাজী এ কথা দ্বিধাহীন ভাবে বলা যায় না। কিন্তু কিছু ভূমি যে উশরী এ কথা সুনিশ্চিতভাবে বলা যায়।
আর উসূল হলো, যে ভূমি উশরী নাকি খারাজী তাতে সন্দেহ হয়, তাকে উশরী সাব্যস্ত করা হয়। সে হিসেবে এ দেশের ভূমি উশরী হওয়াই সঙ্গত। কেননা ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, উশর হলো মুসলমানদের অনুকূল বিষয় কারণ তাতে ইবাদাতের অর্থ আছে। আর খারাজ হলো কাফেরদের অনুকূল বিষয়, কারণ তাতে শাস্তির ধাঁচ আছে।