শামীমকে হত্যার নেপথ্যের কাহিনী
- আপডেট সময়- ০৫:১৭:০৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৭২ বার পড়া হয়েছে
অনলাইন ডেস্ক।।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) বিকেল থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তিন দফায় পেটানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী ও জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম মোল্লাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দেখে ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মৃত্যুর আগে তিন স্থানে তিন দফায় পেটানো হয় শামীমকে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও উপাচার্যের সামনেও তাকে পেটানো হয়।
ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে শামীমকে পিটিয়েছে এমন তিন শিক্ষার্থীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। তারা হলেন-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আহসান লাবীব, ছাত্রদলকর্মী এবং সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের রাজু আহমেদ ও ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের আতিক।

পুলিশ হেফাজতে রাত ৯টার দিকে সাভারের গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা শামীমকে মৃত ঘোষণা করেন। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘জাবি ক্যাম্পাসে একজনকে মারধর করা হচ্ছে এমন খবর পাওয়ার পর পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। বুধবার রাত ৯টা ১০ মিনিটের দিকে অচেতন অবস্থায় তাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার অবস্থা এতটাই গুরুতর ছিল তাকে থানায় না এনে হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
তিন দফায় যেভাবে পেটানো হলো:
বুধবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেট এলাকায় শামীম মোল্লাকে আটক করে শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ১৫ জুলাই রাতে জাবি উপাচার্যের বাসভনের সামনে অবস্থানরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে শামীম মোল্লাকে পিটুনি দেয় শিক্ষার্থীরা।
ওই ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক আহসান লাবীব মাটিতে পড়ে থাকা শামীমকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন। এসময় আরেক শিক্ষার্থী আতিক লাথি মারতে থাকেন শামীমকে। মারধরের সময় সেখানে শ’খানেক শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখছিল।
পরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে শামীমকে প্রক্টর ভবনে নেওয়া হয়। সেখানে শামীমকে দেখেই মারধর করতে চায় একদল বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী। পরিস্থিতি সামলাতে শামীমকে পাশের সিকিউরিটি রুমে নিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ওই কক্ষের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকে শামীমকে মারধর করা হয়।
ভিডিওতে দেখা দেখা যায়, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের রাজু আহমেদ ফ্লোরে লুটিয়ে পড়া শামীমকে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন। অপর এক শিক্ষার্থী জুতা দিয়ে আঘাত করছেন। চশমা পরা এক শিক্ষার্থী লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। সেসময় এক শিক্ষার্থী মারধর না করার অনুরোধ করেন।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, চশমা পরা শিক্ষার্থী ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের কৌশিক। মারধর না করার অনুরোধ জানান ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের নাঈম। এরপর পুলিশ, ভিসি ও প্রক্টরদের উপস্থিতিতে তৃতীয় দফায় মারধর করা হয় শামীমকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন সূত্র বলছে, শামীমের বিরুদ্ধে মামলা থাকায় ও তার নিরাপত্তার স্বার্থে পুলিশকে খবর দেয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছায় পুলিশ। তারা সবার সঙ্গে কথা বলেন। এরপর শামীমকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
দুইজন পুলিশ শামীমকে গাড়িতে তোলার সময় বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকজন শামীমকে মারধর করেন। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টর, নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতু ও তৌহিদ সিয়াম উপস্থিত ছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এবং শামীমকে দফায় দফায় পেটানোর সবগুলো ঘটনার সময় উপস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, শামীমকে মারধরের নেতৃত্ব দিয়েছেন জাবি ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ২০০৩-০৪ শিক্ষাবর্ষের আবু সাঈদ ভূঁইয়া, ছাত্রদলকর্মী সরকার ও রাজনীতি ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষের কৌশিক, একই বিভাগের ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রদলকর্মী রাজন ও ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রদলকর্মী হামিদ উল্লাহ সালমান।
শামীমকে মারধরের বিষয়ে ছাত্রদলকর্মী হামিদ উল্লাহ সালমান ফেসবুকে একটি পোস্টে কমেন্ট করেন, ‘ওরে তো বানাইলাম ডেউয়া ভর্তার মতো।’ এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে অবশ্য সালমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘অতি উৎসাহী কিছু বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থী, ছাত্রদল নেতাকর্মী ও শিবির কর্মীরা শামীমকে পেটানোর সঙ্গে জড়িত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতু বলেন, ‘নতুন কলা ভবনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানে (প্রক্টর ভবনে) জটলা দেখে যাই। তখন মারধর বা কোনোকিছুই ছিল না। আমি দুই মিনিটের ভেতর সেখান থেকে সরে আসি। আমার শরীর ভালো ছিল না।’
হামলার নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রদল নেতা আবু সাঈদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রান্তিকে একজনকে মারধর করা হচ্ছে এমন খবর পেয়ে সেখানে দেখতে যাই। কারণ আমি প্রান্তিকের আশপাশেই ছিলাম। দূরে দাঁড়িয়ে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খবর জানিয়ে আমি চলে আসি। আমি মারধরের নেতৃত্ব দিয়েছি এটা পুরোপুরি মিথ্যা ও বানোয়াট। সংগঠনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে।
সূত্র:মা/ক