সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানে যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ি
- আপডেট সময়- ১১:৫৭:২১ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৩৯ বার পড়া হয়েছে
অনলাইন ডেস্ক।।
সাবেক শেখ হাসিনা সরকারের ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী (জাভেদ) শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ির মালিক তা নয়। এর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান থেকে কেনা। বাড়িগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলারেরও বেশি। বাংলাদেশি টাকায় এই অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও দুবাইয়েও তাঁর অঢেল সম্পদ রয়েছে।
কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সম্প্রচারমাধ্যম আল-জাজিরার এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাতে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা। অনুসন্ধান করেছে আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দল ‘আই ইউনিট’।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান লন্ডনের বাইরে দুবাইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে অন্তত ৫৪টি সম্পদের মালিক হন। যুক্তরাষ্ট্রেও তাঁর সম্পত্তি আছে। সেখানে তিনি নয়টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন। এর মধ্যে পাঁচটি ম্যানহাটানসহ নিউইয়র্কের প্রধান এলাকায় এবং চারটি নদীর ওপারে নিউ জার্সিতে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান দেশের বাইরের এত পরিমাণ সম্পদ তাঁর নির্বাচনী হলফনামা ও ট্যাক্স ফাইলে গোপন করেছেন।
আল-জাজিরা অনুসন্ধান বলছে, লন্ডনে সাইফুজ্জামান চৌধুরীর হয়ে সব সম্পদ দেখাশোনা করেন চট্টগ্রামের রিপন মাহমুদ। সাইফুজ্জামান সিঙ্গাপুরের ব্যাংক ডিবিএস থেকে ঋণ নিয়েছেন। ওই ব্যাংকের কর্মী রাহুল মার্টের বর্ণনায়ও সাইফুজ্জামানের সম্পদের বর্ণনা উঠে এসেছে। কীভাবে তিনি বিদেশে এত সম্পদ গড়েছেন, সেই ধারণাও পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বর্ণনায়ও তাঁর সম্পদ ও ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে। শেখ হাসিনা দেশের বাইরে তাঁর ব্যবসার কথা জানতেন উল্লেখ করে সাইফুজ্জামান আল-জাজিরার অনুসন্ধানী দলকে বলেছেন, ‘আমার এখানে ব্যবসা আছে, সেটা তিনি জানতেন।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুবই কাছের ও বিশ্বস্ত। তিনি ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ভূমিমন্ত্রী করেন। সাইফুজ্জামানও আল-জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমার বাবা প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সত্যি বলতে আমিও।’
আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দলের কাছে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান তাঁর বিলাসী জীবনের গল্পও করেছেন। সেখানে নিজের জুতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা টেইলর-মেডের জুতা। আমি হেরডসেও কাস্টম মেড (নির্দিষ্ট গ্রাহকের জন্য বিশেষভাবে তৈরি) জুতা অর্ডার দিয়েছি। এটি তৈরি হতে চার মাস সময় লাগে। আমি কিনেছি প্রতিটি তিন হাজার পাউন্ডের বেশি দিয়ে।’
এই বিশেষ জুতা তৈরির বিষয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, এগুলো উটপাখি ও কুমিরের বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতা। সম্পূর্ণ বুকের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতাগুলোর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। আর অর্ধেক কুমিরের বুকের চামড়া ও বাছুরের চামড়ার অর্ধেক দিয়ে তৈরি জুতার দাম তিন হাজার পাউন্ড। এটা খুবই ভালো। চার মাস লাগে তৈরি হতে।
স্যুট পছন্দ করেন জানিয়ে সাইফুজ্জামান বলেন, প্রতিবার তিনি লন্ডনে গেলে দু-তিন হাজার পাউন্ড স্যুট কিনতে ব্যয় করেন। সুপার ২০০, সুপার ১৮০-এগুলো কেনা হয়। সুপার ২০০-এর দাম ছয় হাজার পাউন্ড। কেনালি বন্ড স্ট্রিটে গিয়ে কেনেন তিনি। এরপর তারাই বাসায় পৌঁছে দেয়।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগে থেকে সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে অনুসরণ করছিল তাদের অনুসন্ধানী দল। তাঁর বেতন (বার্ষিক) ছিল ১৩ হাজার ডলার। অথচ তিনি যুক্তরাজ্যে বিপুল সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। আই ইউনিট মন্ত্রীর বৈশ্বিক সম্পদের অনুসন্ধানে নেমে চমকে ওঠার মতো সম্পদের সন্ধান পায়। বাংলাদেশে সাইফুজ্জামানের সম্পদের উৎস তাঁর ব্যবসা ও ইউসিবি ব্যাংকের শেয়ার।
বাংলাদেশর মুদ্রানীতি অনুযায়ী, দেশের নাগরিকেরা বছরে ১২ হাজার ডলারের বেশি বিদেশে নিতে পারেন না। এই মুদ্রানীতি হয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সুরক্ষার জন্য।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যপকহারে কমে গেছে। কেউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া বিদেশে টাকা নিয়ে গেলে সেটা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ।’
লন্ডনে বাড়িগুলো তৈরির বিষয়ে আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, সাইফুজ্জামান ডেভেলপারদের কাছ থেকে বাড়ি কেনার জন্য বেশ কিছু কোম্পানি তৈরি করেন। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তিনি যুক্তরাজ্যে ২৬৫টি বাড়ি কেনেন। তাঁর বাড়িগুলোর বেশির ভাগই বার্কলি গ্রুপের মতো শীর্ষ ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনা।
সাইফুজ্জামানের কেনাকাটা সেখানেই থেমে থাকেনি। ২০২১ সালে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলারে লন্ডনে আরও সম্পদ কেনেন তিনি। তাঁর বেশির ভাগ সম্পদই ভাড়া দিয়ে থাকেন। ২০২০ সালে আরও ৮৯টি বাড়ি কিনলে মোট বাড়ির সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬০টি, যার বাজারমূল্য ৩২ কোটি ডলার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তিদের যুক্তরাজ্যে কঠোর যাচাইয়ের মুখোমুখি হওয়ার কথা। সেখানে সাইফুজ্জামান চৌধুরী কীভাবে এই যাচাইপ্রক্রিয়া অতিক্রম করেছিলেন, তা যাচাইয়ে তার একটি সম্পত্তি দেখতে যায় আল–জাজিরার অনুসন্ধানী দল।
সেখানে রিপন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের গ্রাহকের (সাইফুজ্জামানের) লন্ডনে ৩০০টি বাড়ি আছে। তিনি লন্ডনে আসেন, কয়েকটি বাড়ি কেনেন, আবার চলে যান। লকডাউনের সময় যুক্তরাজ্যে নতুন বাড়ি কেনার জন্য ২০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করেন তিনি।’
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে লেনদেন স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে। সাইফুজ্জামানের বর্তমান অবস্থান অজানা। তবে বাংলাদেশ ছেড়েছেন বলে সাম্প্রতিক একটি কথোপকথনে তিনি উল্লেখ করেছেন।
সূত্র:মা/ক