ত্রিভুজ প্রেমের বলি আশরাফুল, হত্যার দুদিন পর মরদেহ ২৬ খন্ড করে ফেলে যায়
- আপডেট সময়- ০৪:০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫ ২ বার পড়া হয়েছে

অনলাইন নিউজ ডেস্ক।।
রাজধানীতে কাঁচামাল ব্যবসায়ী আশরাফুল হকের ২৬ খণ্ড মরদেহ উদ্ধারের পর দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের গেটের কাছে দুটি নীল রঙের ড্রামে তার ২৬ টুকরো খন্ড মরদেহ পাওয়া যায়। এমন নৃশংস হত্যার ঘটনায় আসামি করা হয় তার বন্ধু জরেজুল ইসলামকে।
সূত্রে জানা গেছে, শামীমা আক্তার নামে এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন দুই বন্ধু আশরাফুল ও জরেজ। এ নারীর সঙ্গে দুজনের ছিল ত্রিভুজ প্রেম। কিন্তু এই প্রেম তাদের বন্ধুত্বে ফাটল তৈরি করেছিল। যার জেরে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হতে হয় আশরাফুলকে।ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) স্বল্প সময়ের মধ্যে ভয়াবহ এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়।
ডিবি সূত্রে জানা গেছে, আশরাফুলকে প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে ধরে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করা হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর দু’দিন পর তার মরদেহ কেটে ২৬ টুকরো করা হয়। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন জরেজ ও শামীমা আক্তার দুজনেই।
এ ঘটনায় আশরাফুলের বন্ধু এবং হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি জরেজুলকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। শুক্রবার (১৪ নভেম্বর) রাত ১০টার দিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে।
অন্যদিকে র্যাব-৩ এর একটি দল লাকসাম থেকে হত্যাকাণ্ডের অপর আসামি পরকীয়া প্রেমিকা শামীমাকে গ্রেপ্তার করে।
ডিবি সূত্রে আরও জানা গেছে, শামীমা আক্তার মূলত কুমিল্লার বাসিন্দা। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। শামীমার স্বামী সৌদি আরবে থাকেন। বছর তিনেক আগে ফেসবুক ও মেসেঞ্জারের মাধ্যমে তার সম্পর্ক হয় মালয়েশিয়া প্রবাসী জরেজুল ইসলামের সঙ্গে। ছুটিতে দেশে ফেরার পর শামীমার সঙ্গে জরেজুলের প্রেম এবং অনৈতিক সম্পর্ক শুরু হয়।
☞যেভাবে হত্যা করা হয় করা আশরাফুলকে:
রংপুরে একই এলাকায় থাকা জরেজুল ও আশরাফুলের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল। জরেজুলের মাধ্যমে আশরাফুলের সঙ্গে শামীমার পরিচয় হয়। এ পরিচয়ের সূত্রধরে দুজনের মধ্যে এক পর্যায়ে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মালয়েশিয়া থেকে ঢাকায় এসে জরেজুল দক্ষিণ ধনিয়ায় একটি বাসা ভাড়া নেন। শামীমাও তার পরিবার কুমিল্লায় রেখে ওই বাসায় ওঠেন। পরে বন্ধুর বাসায় যায় আশরাফুল। ওই সময় জরেজুলের সঙ্গে শামীমার অনৈতিক সম্পর্কের কথা জেনে যায় আশরাফুল। এটা জানার পর সেও অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয় শামীমার সঙ্গে।
এ বিষয়টি টের পেয়ে যায় জরেজুল। তখন ক্ষিপ্ত হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বের হওয়ার সময় ভুলে আশরাফুলের মোবাইল ফোনও সঙ্গে নিয়ে যায়। পরে মোবাইল দিতে ফিরে এসে দেখে শামীমা ও আশরাফুল একসঙ্গে ঘুমিয়ে আছে। ওই সময় জরেজুল বাসার ভেতরে গোপনে রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
ডিবি সূত্রে আরও জানা গেছে, রাতের কোনো এক সময় আশরাফুলকে বালিশ চাপা দিয়ে ধরেন জরেজুল। ওই সময় শামীমাও সেখানে ছিলেন। এক পর্যায়ে হাতুড়ি দিয়ে মাথায় আঘাত করলে আশরাফুল ঘটনাস্থলেই মারা যান।
হত্যার পর মরদেহটি দু’দিন বাসার ভেতরে রাখা হয়। পরে দুইজন রাতের অন্ধকারে মরদেহ ২৬ টুকরো করে দুটি ড্রামে ভরে গত বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) হাইকোর্ট সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহ মাঠের সামনে ফেলে দেন এবং তারা কুমিল্লায় পালিয়ে যান।
রাজধানীর ব্যস্ততম এলাকায় জাতীয় ঈদগাহের সামনে দীর্ঘক্ষণ দুটি ড্রাম পড়ে থাকতে দেখে পুলিশকে খবর দেয় স্থানীয়রা। তখন পুলিশ এসে ড্রাম তল্লাশি করে খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করে।
জানা গেছে, আশরাফুল একটি মামলার বাদী ছিলেন। সে কারণে তার ডাটাবেজ পুলিশের কাছে ছিল। পরে সিআইডি এসে তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিলে নামপরিচয় শনাক্ত হয়। নামপরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই ডিবি হত্যাকাণ্ডের ছায়া তদন্ত শুরু করে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি-দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ত্রিভুজ প্রেমের জের ধরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। আশরাফুল ও জরেজুল ইসলাম একে অপরের বন্ধু হলেও শামীমা নামে এক নারীর সঙ্গে তাদের দুই জনেরই পরকীয়াসহ অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে উঠে। এই সম্পর্ককে কেন্দ্র করে আশরাফুল তার বন্ধু ও প্রেমিকার হাতে খুন হয়। মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে এ বিষয়ে ডিবি তদন্ত শুরু করে।
পরে তথ্যপ্রযুক্তি সহযোগিতায় শুক্রবার রাত ১০টায় কুমিল্লা থেকে জরেজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে এবং এ বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
☞২৬ টুকরো মরদেহের অবস্থা ছিল খারাপ:
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. দীপিকা রায় আশরাফুলের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গলা থেকে নিচ পর্যন্ত ২৫ টুকরো, মাথাসহ মোট ২৬ টুকরো লাশ পাওয়া গেছে। চুল ও দাঁত স্বাভাবিক থাকলেও গলার নিচের অংশের অনেক অংশ মিল পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।এর আগে শুক্রবার আশরাফুলের বোন আনজিনা বেগম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় জারেজুল ইসলামকে প্রধান আসামি করা হয়।
নিহতের বোন আনজিনা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, আশরাফুল কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। তিনি দিনাজপুর হিলি বন্দর থেকে সারাদেশে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ, আলুসহ বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল সরবরাহ করেন। গত ১১ নভেম্বর রাত ৮টায় আশরাফুল ও জরেজ ঢাকার উদ্দেশ্যে রংপুরের বদরগঞ্জের গোপালপাড়া থেকে রওনা হয়। তারপর থেকে আশরাফুলের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজাখুঁজি করি, কিন্তু তাকে (আশরাফুল) পাওয়া যায়নি।
এজাহারে আরও অভিযোগ করা হয়, গত ১৩ নভেম্বর রাত সাড়ে ৭টায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখতে পাই এবং জানতে পারি যে, শাহবাগ থানা পুলিশ হাইকোর্ট পানির পাম্প সংলগ্ন এলাকা থেকে ২টি নীল রংয়ের ড্রামের ভেতর থেকে অজ্ঞাতনামা পুরষের খণ্ডিত মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। ওই সংবাদ দেখতে পেয়ে আত্মীয়-স্বজনসহ শাহবাগ থানা যাই ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে খণ্ডিত মৃতদেহের মুখমণ্ডলসহ দেহের বিভিন্ন অংশ দেখে আমার ভাই আশরাফুল হকের মরদেহ শনাক্ত করি। আমিসহ আমার পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ যে, জরেজ তার সহযোগী অজ্ঞাতনামা আসামিদের সহযোগিতায় গত ১১ নভেম্বর থেকে ১৩ নভেম্বর এর মধ্যে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে আশরাফুল হককে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
এজহারে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, মুখমণ্ডলসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ মোট ২৬টি খণ্ডে খণ্ডিত করা হয়। মরদেহ গোপন করার উদ্দেশ্যে ২টি নীল রংয়ের ড্রামের ভেতর ভরে ড্রামের মুখ কালো রংয়ের ঢাকনা দিয়ে ঢেকে শাহবাগ থানাধীন হাইকোর্ট পানির পাম্পে রাস্তার ওপরে ফেলে রেখে হত্যাকারীরা অজ্ঞাতস্থানে পালিয়ে গেছে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল হক হিলি স্থলবন্দর থেকে কাঁচামাল কিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাইকারী বিক্রি করতেন। তার বন্ধু জরেজ মিয়া সদর উপজেলার শ্যামপুরের বাসিন্দা। জরেজ দীর্ঘদিন মালয়েশিয়া ছিলেন। দেশের ফেরার পর আশরাফুলের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় তার।
আশরাফুলের সব ব্যবসা-বাণিজ্য, হিসাব-নিকাশ রাখতেন জরেজ। গত মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) আশরাফুল হক বন্ধু জরেজসহ ব্যবসার কাজে ঢাকায় যান। বুধবার বিকেলে আশরাফুলের সঙ্গে স্ত্রী লাকী বেগমের শেষ কথা হয়। এরপর থেকে আশরাফুলের সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারেনি পরিবারের সদস্যরা। বৃহস্পতিবার বদরগঞ্জ থানায় জিডি করতে আসেন পরিবারের সদস্যরা। সেখানে এসে জানতে পারেন আশরাফুল হককে ঢাকায় নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তার খণ্ডিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
আশরাফুলের কাছে ১০ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলেন জরেজ— বললেন তার স্ত্রী।
আশরাফুলের স্ত্রী লাকী বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীর কাছে বিদেশ যাওয়ার জন্য ১০ লাখ টাকা ধার চেয়েছিলেন জরেজ। গত মঙ্গলবার জরেজুল আমার স্বামীকে ঢাকায় নিয়ে যান। এরপর স্বামীকে ফোনে পাই না। তার ফোন ধরে জরেজুল বলেন আপনার স্বামী ফোন রেখে কালেকশনে গেছে। আমি কী বাচ্চা ছাওয়াল, কিছুই বুঝি না। আমার স্বামীকে খুন করে করেছে ওই জরেজুল। আমি তার কঠোর বিচার চাই।’
হত্যাকাণ্ড নিয়ে বৃহস্পতিবার ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাসুদ আলম সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবার বাড়ি থেকে আশরাফুল ঢাকায় আসেন। বুধবার রাত ৯টা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার কথা হয়। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। ভারত ও মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ এবং আলু আমদানি করতেন আশরাফুল। পণ্য আমদানির জন্য তার সরকারি লাইসেন্স রয়েছে।




































































































