সর্বশেষ:-
প্রাচীন অস্পৃশ্য গ্রাম মালানা গণতন্ত্রের নিঃশব্দ সাক্ষী

প্রতিনিধির নাম
- আপডেট সময়- ০৫:৪৫:৫৯ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ জুলাই ২০২৫ ৩১ বার পড়া হয়েছে

ঋতম্ভরা ব্যানার্জি,কলকাতা।।
মালানা, এক অস্পৃশ্য গ্রাম।হিমাচল প্রদেশের কুল্লু জেলার পার্বতী উপত্যকার এক নির্জন কোণে, প্রায় ৯,৯৩৮ ফুট উচ্চতায় গড়ে উঠেছে এক রহস্যে মোড়া প্রাচীন গ্রাম— মালানা (Malana)। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, প্রাচীন ইতিহাস, নিজস্ব সমাজব্যবস্থা এবং এক অনন্য সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য এই গ্রামটি ভারতের অন্যতম বিস্ময় হিসেবে পরিচিত। যদিও হিমাচলের মানালি, কুল্লু বা শিমলা পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়, মালানার নাম এখনও অনেকেরই অজানা।
📜 এক পৌরাণিক ঐতিহ্যের সাক্ষী:-
▪️ মালানার মানুষজন দাবি করেন, তারা সম্রাট আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট-এর সেনাবাহিনীর বংশধর। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় তার কিছু সৈন্য হিমালয়ের এই দুর্গম অঞ্চলে আশ্রয় নেয় এবং এখানেই থেকে যায়। তাদের উত্তরসূরিরাই নাকি আজকের মালানা গ্রামের বাসিন্দা। এই ইতিহাসের প্রমাণ হিসেবে গ্রামের একটি প্রাচীন মন্দিরে আলেকজান্ডারের সময়কার একটি তলোয়ার সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানা যায়।
🗣️ ভাষা, সমাজ ও নিয়মে ভিন্ন এক জগৎ:-
▪️ মালানাবাসীরা ‘কানাশী’ নামে এক পবিত্র ভাষায় কথা বলেন, যা ভারতের আর কোথাও প্রচলিত নয় এবং বাইরের মানুষকে এই ভাষা শেখার অনুমতি নেই। গ্রামের মানুষজন নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এতটাই কঠোরভাবে রক্ষা করেন যে, বহিরাগতদের সঙ্গে শারীরিক স্পর্শ পর্যন্ত নিষিদ্ধ। এমনকি গ্রামের কোনও মন্দিরে কেউ ভুলবশত ছুঁয়ে ফেললে জরিমানা দিতে হয়।
▪️ এখানে বিয়ে হয় শুধুমাত্র গ্রামের মধ্যেই, বাইরের কারো সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক একেবারেই বর্জিত। এভাবেই তারা নিজেদের পরিচয় ও রক্তরেখা রক্ষা করে আসছেন প্রাচীনকাল থেকে।
🏛️ বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রের দাবিদার:-
▪️ মালানাকে অনেকেই বলেন “বিশ্বের প্রাচীনতম গণতান্ত্রিক গ্রাম”। পৌরাণিক ঋষি জামলু দেবতা-র আদেশে পরিচালিত হয় এই গ্রামের শাসনব্যবস্থা। গ্রামে রয়েছে ১১ সদস্যের একটি গ্রাম পরিষদ, যাঁরা যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেন। এখানে ভারতের আইন বা পুলিশের কার্যকারিতা নেই— আইন, বিচার ও শাস্তি সবকিছুই গ্রামেই ঠিক হয়। পুলিশ গ্রামে ঢুকতে পারলেও গ্রামবাসীদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
🌿 ‘মালানা ক্রিম’ ও বৈশ্বিক কুখ্যাতি:-
▪️ বিশ্বজোড়া খ্যাতি মালানার আরেকটি পরিচিতি— ‘মালানা ক্রিম’। এটি এক ধরনের চরস, যা মালানার পাহাড়ি জঙ্গলে জন্মানো গাঁ*জা গাছ থেকে তৈরি হয়। এটি এতটাই উন্নতমানের যে, বিশ্বের অন্যতম সেরা চরস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। হাই টাইমস ম্যাগাজিন ১৯৯৪ ও ১৯৯৬ সালে “সেরা মারিজুয়ানা” হিসাবে মালানা ক্রিমকে ক্যানাবিস কাপ দিয়েছে।
তবে বর্তমানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে গাঁ*জা চাষ বন্ধে অভিযান চালানো হলেও, মালানার উচ্চ উচ্চতা ও দুর্গম পথ এই কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবুও, এখানকার চরস উৎপাদন এখনও বিশাল অঙ্কের অর্থনৈতিক প্রভাব রাখে।
🧗♂️ পর্যটন, প্রকৃতি ও বিচ্ছিন্নতা:-
▪️ মালানায় ট্রেন বা বাসে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই। কুল্লু থেকে ৪৪ কিমি দূরে অবস্থিত এই গ্রামে যেতে হলে শেষ ২ ঘণ্টা পাহাড়ি ট্রেক করে যেতে হয়। যদিও এখানকার সৌন্দর্য ও রহস্য অনেক পর্যটকের কৌতূহল জাগায়, তবুও স্থানীয়দের কঠোর নিয়ম-কানুন ও বিচ্ছিন্ন মানসিকতা পর্যটকদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
এখানে ছবি তোলা অনুমোদিত, কিন্তু ভিডিও করা নিষিদ্ধ। স্থানীয়রা বাইরের মানুষের সঙ্গে খুব কম যোগাযোগ রাখেন, ফলে এখানকার সমাজ নিজস্ব গতিতে চলে।
🦠 করোনামুক্ত গ্রাম!
▪️ আশ্চর্যের বিষয় হল, করোনা মহামারির সময়েও মালানা একেবারে সংক্রমণমুক্ত ছিল। এই বিচ্ছিন্ন অবস্থান ও বাহ্যিক সংস্পর্শ এড়িয়ে চলার কঠোর সংস্কার এই সফলতা এনে দেয়।
🔚 মালানা শুধু একটি গ্রাম নয়— এটি এক জীবন্ত কিংবদন্তি। ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, অর্থনীতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন এই গ্রামে প্রতিফলিত হয়। আধুনিক ভারতের বুকেও মালানা যেন এক পৃথক সভ্যতার নিদর্শন— যেখানে সময় থেমে আছে, আর মানুষ বেঁচে আছে নিজের মতো করে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে।
নিউজটি শেয়ার করুন
ট্যাগস:-

-
সর্বশেষ সংবাদ
-
জনপ্রিয় সংবাদ