সর্বশেষ:-
বয়কট এখন একটি অতিমারি সিনেমা জগতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
প্রতিনিধির নাম
- আপডেট সময়- ০৯:১১:২৯ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৪ ১৩৪ বার পড়া হয়েছে
ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়,কলকাতা।।
১৯৪৭ সালের আগে একটা সময় ছিল যখন দেশাত্মবোধের জন্য ব্রিটিশ সামগ্রী বর্জন তথা বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে।
এরপর দেশ ভাগের পর ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের তিক্ততায় পাকিস্তান ক্রিকেট দলের খেলা বন্ধ করার জন্য প্রয়াত শিব সেনা প্রমুখ বাল ঠাকরের সমর্থকেরা মুম্বাইতে ক্রিকেট মাঠের পিচে খোদাই করে পাকিস্তানি ক্রিকেটকে বয়কট করার ডাক দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়,ভারত চীন সম্পর্ক সীমান্ত সংঘর্ষের ফলে তিক্ত হয়ে ওঠার পর ভারতে চীনা সামগ্রী বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিল। এসব ছিল সম্পূর্ন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মামলা। কিন্তু এখন এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হচ্ছে আমাদের।
লাগাতার ভারতের বিভিন্ন চলচ্চিত্রকে বয়কটের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে এটি এক অতিমারির রূপ নিয়ে ফেলেছিল। সেই ট্র্যাডিশন এখনো চলছে।
সম্প্রতি বলিউডে যেন ‘বয়কট’য়ের ঝড় বইছে। এমন অনেক সিনেমা আছে যেগুলি সাম্প্রতিক কালে রিলিজের আগে থেকেই বয়কটের সম্মুখীন হয়েছে। শাহরুখ খান থেকে অক্ষয় কুমার ,আমির খান থেকে করিনা কাপুর, রনবীর কাপুর থেকে অমিতাভ বচ্চন পর্যন্ত এই বয়কটের শিকার হয়ে পড়েছেন।
কিছুকাল আগে সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছে ‘লাল সিং চাড্ডা’ এবং ‘রক্ষা বন্ধন’। দুটি ছবিই বয়কট প্রবণতার মুখোমুখি হয়েছে। বলিউডের অনেক বিগ বাজেটের ছবি এখনও মুক্তির অপেক্ষায়। সেই গুলি নিয়েও খানিকটা প্রতিবাদের সুর শোনা যাচ্ছে। এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার চলছে। ” বয়কট, বয়কট,বয়কট” পোস্টিং এর মিছিল চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতে।
সবচেয়ে বেশি টার্গেট করা হয়েছে , আমির খানের,” লাল সিং চাড্ডা”, শাহরুখ খানের,”পাঠান”, রনবীর কাপুরের,”ব্রহ্মাস্ত্র”, বিজয় দেবেরাকোন্ডার “লাইগার”, সইফ আলি খানও রাধিকা অপ্তের,”বিক্রম বেদা” , অক্ষয় কুমারের, “রাম সেতু”, “রক্ষা বন্ধন” ইত্যাদি।
লাইগার-: ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেন দক্ষিণের তারকা বিজয় দেবেরাকোন্ডা। প্রযোজনা করেছে করণ জোহরের ধর্ম প্রোডাকশন। সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর থেকে করণ জোহর প্রতিনিয়ত লক্ষ্যবস্তু। এই কারণে অতীতে বয়কটের প্রবণতা ছিল। ২৫ অগস্ট মুক্তি পেয়েছে লাইগার।
ব্রহ্মাস্ত্র-: ৯ সেপ্টেম্বর করণ জোহরের প্রযোজিত ব্রহ্মাস্ত্র ছবিটি মুক্তি পেয়েছে।ব্রহ্মাস্ত্রের ট্রেলার মুক্তির পর পরই একটি দৃশ্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। বলা হয়েছিল রণবীর জুতা পরে মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করেছিলেন। পরিচালক অয়ন মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, তিনি মন্দিরে নয় দুর্গা পুজোর প্যান্ডেলে প্রবেশ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ছবিতে রনবীর কাপুরকে জিন্সের প্যান্ট পড়ে হাতে ত্রিশূল নিয়ে হাজির হওয়া নিয়ে প্রচন্ড উত্তেজিত হয়েছে জনতা। সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে এই ছবি। বলা হয়েছে, রণবীর কাপুর এর দ্বারা শংকর ভোলানাথকে অপমান করে হিন্দু ধর্মের অবমাননা করেছেন। ছবিতে অমিতাভ বচ্চন এবং করিনা কাপুরও রয়েছেন। এই ছবিটিও বয়কটের মুখে পড়েছে। শুধু তাই নয়, সোশ্যাল মিডিয়াতে অমিতাভ বচ্চন , রনবীর কাপুর, এবং করিনা কাপুরের দ্বারা সকল বিজ্ঞাপিত বস্তুর বয়কটের দাবিও করা হচ্ছে।
বিক্রম বেদা: – ছবিতে অভিনয় করেছেন হৃতিক রোশন, সইফ আলি খান এবং রাধিকা আপ্তে। ছবিতে সইফের উপস্থিতির কারণে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা তাঁকে বয়কটের দাবি করে চলেছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর বড় পর্দায় আসতে চলেছে ছবিটি।
তেজস: ৫ অক্টোবর মুক্তি পাবে তেজস। কঙ্গনা রানাওয়াতের ছবি অবশ্য এখনও বয়কটের মুখোমুখি হয়নি।
রাম সেতু: অক্ষয় কুমারের আসন্ন ছবি রাম সেতুও হিন্দু সংগঠনের নিশানায়। ছবিতে ভুল তথ্য যোগ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। ছবিটি ২৪ অক্টোবর মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে।
শাহজাদা: ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন কার্তিক আরিয়ান। ৪ অক্টোবর মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে এই ছবির। মহিলা প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন কৃতি স্যানন। যদিও ‘বয়কট’-এর ধারা থেকে এখনও দূরে রয়েছে এই ছবি।
সার্কাস: রোহিত শেট্টি পরিচালিত এই ছবি মুক্তি পাবে আগামী ২৫ ডিসেম্বর। ছবিতে অভিনয় করেছেন রণবীর সিং, পূজা হেগড়ে এবং জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজ। বয়কট প্রবণতা থেকেও এই ছবিটি নিরাপদে রয়েছে।
কাভি ইদ কাভি দিওয়ালি (ভাইজান)- ৩০ ডিসেম্বর ছবি মুক্তির তারিখ। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন সলমন খান ও পূজা হেগড়ে। বেশ কিছুদিন ধরেই খান অভিনেতাদের সিনমার প্রতিনিয়ত বিরোধিতা করা হচ্ছে।
আদিপুরুষ- প্রভাসের পাশাপাশি ছবিতে অভিনয় করেছেন সইফ আলি খান ও কৃতি স্যানন। ছবিতে সইফ থাকার কারণে এই ছবি নিয়েও বয়কটের ডাক শোনা গিয়েছে। আগামী বছরের ১২ জানুয়ারি মুক্তি পাবে ছবিটি।
পাঠান- শাহরুখের এই ছবিও বয়কট প্রবণতার মুখোমুখি হয়েছে। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন শাহরুখ খান, দীপিকা পাড়ুকোন ও জন আব্রাহাম। ২৫ জানুয়ারি ২০২৩ সালে মুক্তি পাবে এই ছবি।
বয়কট মুভির বয়কট করা হয়।
অভিনেত্রী হুমা খুরেশিকে শীঘ্রই দেখা যাবে ‘মহারানি’ সিরিজের দ্বিতীয় সিজনে। এই সিরিজের প্রচারে এখন ব্যস্ত হুমা। সেখানেই তিনি বলিউডের ছবি ঘিরে যে ‘নেতিবাচক’ কথাবার্তা চলছে তা নিয়ে মন্তব্য করেন। বিশেষ করে বলিউড ছবিকে ‘বয়কট’ করা নিয়ে তিনি মতামত পেশ করেন। আর সেই সঙ্গে সিনেমা ফ্লপ হচ্ছে বলে বলিউড শেষ হয়ে যাচ্ছে এটা ভাবতেও তিনি নারাজ। তিনি মনে করেন, মানুষ একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছেন হিন্দি সিনেমার ভবিষ্যৎ ভাবনা নিয়ে। এই বছর ‘গাঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি’ আর ‘ভুল ভুলাইয়া ২’ ছবি ছাড়া অন্য কোনও সিনেমা সেইভাবে বক্স অফিসে প্রভাব ফেলতে পারেনি। আলিয়া ভাট অভিনীত, সঞ্জয়লীলা ভনশালি পরিচালিত ‘গাঙ্গুবাঈ কাথিয়াওয়াড়ি’ ছবিতে হুমা নিজেও ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করেন।
প্রতিক্রিয়া:
মুক্তির আগে এবং পরে বলিউডের বহু ছবি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে বয়কটের ঝড় উঠেছে। ফলে বিশাল অঙ্কের ছবি গুলির তারক,তারকাদের একের পর এক ছবির ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিপাকে পড়েছেন প্রযোজকেরা।এনিয়ে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন অনেক অভিনেতা,অভিনেত্রী।
সুনীল শেট্টি বলেছেন,”সম্প্রতি মুক্তি প্রাপ্ত কিছু ছবি বয়কটের কারণে সংস্কৃতির ওপর বড় রকমের প্রভাব পড়েছে। যে ছবি গুলি বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করতে পারতো,সেগুলি অনেকটাই হোচোট খেয়েছে।
আমির খানের,”লাল সিং চাড্ডা”ও অক্ষয় কুমারের ,”রক্ষা বন্ধন” বয়কটের ফলে অনেকটাই সংকটের মুখে পড়েছে।দুটি ছবিই ১১ আগস্ট মুক্তি পেয়েছে। হিন্দু ধর্মের অনুভূতির ওপর চরম আঘাতের অভিযোগে এদের বিরুদ্ধে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়। অক্ষয় কুমার আবেদন জানিয়েছেন, কোন ছবি যেন বয়কট না করা হয়।২০২২ অক্ষয় কুমারের কাছে অভিশাপ নিয়ে এসেছে। তার ছবি ,” বচ্চন পান্ডে ও সম্রাট পৃথ্বীরাজ” বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এখন আবার রক্ষা বন্ধন তার কপালে চিন্তার ঢেউ তুলে দিয়েছে।
বয়কটের উল্টো প্রতিক্রিয়াও রয়েছে। আমার পরিচিত অনেককেই দেখেছি, সোশ্যাল মিডিয়াতে বয়কটের ডাক দেখেই কৌতুহলের বশে রক্ষা বন্ধন দেখে এসেছেন। এক বন্ধু জানালো, প্রকৃত কী আছে দেখতেই গিয়েছিলাম। সূক্ষ ও মারাত্মক ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের কথা অনেকে বলছেন। কিন্তু আসলে সবটুকু সত্যি নয়।
পরিশেষে বলতে চাই,আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা সারা বছর অসংখ্য ঝামেলায়, ক্লান্ত হয়ে পড়ে মাঝে মাঝেই চিত্ত বিনোদনের জন্য সিনেমা দেখতে যাই। সংস্কৃতির ধারক বাহক এই সিনেমা যদি অপসংস্কৃতির রূপ নেয়,সেটা কখনোই কাম্য নয়। সিনেমা মানুষের ভাবনাকে অনেকটাই প্রভাবিত করে। তাই সিনেমাকে স্বচ্ছ ও কালিমামুক্ত করাটাই বাঞ্ছনীয়। একথাও বলা দরকার,এই বৃহৎ বাজেটের ছবির সঙ্গে শুধু তারকারাই নন,হাজার হাজার কলাকুশলী ও কর্মীরা জড়িয়ে রয়েছেন।তাদের দিকটাও ভেবে দেখা দরকার। অহেতুক রটনার পিছনে অন্ধের মতো ছোটা উচিৎ নয়। অপসংস্কৃতি হলে অবশ্যই বয়কটের ডাক সমর্থন যোগ্য।