রাসূলুল্লাহ(সা.)এর জন্ম তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের অভিমত: ফেরদৌস আলম
- আপডেট সময়- ০৭:১৮:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৫৫ বার পড়া হয়েছে
যুগে যুগে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষদের হেদায়েতের জন্য অসংখ্য নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন ঘটে । তার জন্ম দিন নিয়ে সকল ঐতিহাসিক ও ইসলামী স্কলার এক মত পোষণ করলেও তারিখ নিয়ে অভিমত রয়েছে।
ঐতিহাসিকদের মধ্যে বেশিরভাগই ৫৭০ খ্রিস্টাব্দ তাঁর জন্ম বছর বলে উল্লেখ করেন। প্রকৃতপক্ষে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে পিতা আবদুল্লাহর ঔরসে ও মাতা আমেনার গর্ভে তিনি আগমন করেন এবং ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভূমিষ্ঠ হন।
খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী তাঁর জন্ম তারিখ ২০ এপ্রিল। আরবি হিজরি সন অনুযায়ী তারিখটি ৯ রবিউল আউয়াল। কোনো কোনো ইতিহাসবিদ বলেছেন, ১২ রবিউল আউয়াল। তবে দিন হিসেবে সোমবার সম্পর্কে কোন মতভেদ নেই।
জীবনচরিতকাররা একমত যে রবিউল আউয়াল মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে সোমবার দিন সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্ম হয়। এই সোমবার রবিউল আউয়াল মাসের ৮ অথবা ৯ কিংবা ১২ তারিখ, এখানেই পার্থক্য রয়েছে।
সিরাত তথা রাসূল (সা.) এর জীবনিকারদের মধ্যে অন্যতম ইবনে হিশাম তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, রাসূল (সা.) এর জন্ম সম্পর্কে সাধারণত প্রসিদ্ধ উক্তি এই যে তিনি রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার এ আবির্ভূত হন।
যুবায়র (রা) বলেছেন, তিনি রমজান মাসে জন্মগ্রহণ করেন।
কারো কারো মতে, আমিনা গর্ভধারণ করেন আইয়ামে তাশরিকে অর্থাৎ জিলহজ মাসের মাঝামাঝি সময়। এ উক্তি সঠিক হলে রাসূল (সা.) এর জন্মগ্রহণ রমজান মাসে এটিও সঠিক।
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ লিখেছেন, হস্তিবাহিনীর ঘটনার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম হয়। আর এটি ঘটেছিল ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল । এর মাধ্যমে জানা গেল যে, ইসা আ.-এর জন্মের ৫৭১ বছর পর নবিজির জন্ম হয়।
ইবনু আসাকির (রাহ.) পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে লেখেন, আদম (আ.) ও নুহ (আ.)-এর মধ্যখানে ১ হাজার ২০০ বছরের ব্যবধান ছিল। নুহ (আ.) ও ইবরাহিম (আ.) এর মধ্যখানে ছিল ১ হাজার ১৪২ বছরের ব্যবধান। ইবরাহিম থেকে মুসা (আ.) ৫৬৫ বছরের। মুসা থেকে দাউদ (আ.) পর্যন্ত ৫৬৯ বছরের। দাউদ থেকে ইসা (আ.) পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫৬ বছর এবং ইসা (আ.) থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত ৬০০ বছরের ব্যবধান ছিল।
এ হিসাবে হযরত আদম (আ.) থেকে আমাদের নবি হযরত মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত ৫ হাজার ৩২ বছরের ব্যবধান ছিল। তা ছাড়া প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী আদম(আ.)-এর বয়স হয়েছিল ৯৬০ বছর। তাই আদম (আ.)-এর পৃথিবীতে আগমনের প্রায় ৬ হাজার বছর পর অর্থাৎ সপ্তম সহস্রাব্দে নবিজির জন্ম হয়।
মোটকথা, আসহাবে ফিল তথা হস্তিবাহিনী কর্তৃক কাবা আক্রমণের বছর ১২ রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার পৃথিবীর ইতিহাসে অনন্য এক দিন ছিল যে দিনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্ম গ্রহণ করেন।
সংখ্যাগুরু ঐতিহাসিকদের বক্তব্য এই যে হাতিবাহিনী কাবা শরিফে এসেছিল মহরম মাসে এবং এর ৫০ দিন পর তিনি আবির্ভূত হন। এ মতটিই অধিক প্রচলিত এবং সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। (ইবনে হিশাম: সিরাতুন্ নবী (সা.), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ঢাকা)
নবী (সা.) এর জন্ম কাহিনিতে হস্তীবর্ষ বা হস্তিবাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। আর এটা হলো ‘সূরা ফিল’ এ বর্ণিত ইয়েমেনের বাদশাহ আবরাহা কর্তৃক কাবাঘর ধ্বংস করার অভিযানের বছরের কথা। ঐতিহাসিকরা মনে করেন, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে আবরাহা কাবাঘর ধ্বংসের জন্য অভিযান পরিচালনা করেছিল। এর ৫০/৫৫ দিন পরই নবী (সা.) কাবাঘরের সন্নিকটে তার পিতৃভূমিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
আরব ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রথমদিকে যারা নবী (সা.) এর জীবনী লিখেছেন, তাদের মধ্যে ইবনে ইসহাক অন্যতম। ইবনে হিশামও তার গ্রন্থ থেকে অনেক তথ্য উল্লেখ করেছেন। মুহাম্মদ ইবনে ইসহাকের গ্রন্থের নাম ‘কিতাবুল মুবতাদা’। এ গ্রন্থে ইবনে ইসহাক জনৈক কায়েস ইবনে মাখরামার সাক্ষাতকার প্রকাশ করেন, যেখানে কায়েস বলেছেন, আমি এবং রাসূল (সা.) আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী। এ থেকে নবী (সা.) এর জন্ম বছরটি ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ হিসেবে সঠিক আছে।
এ মতামতের ভিত্তিতে একটি হাদিস ও পাওয়া যায় যেখানে রাসূল (সা.) এর জন্ম সময় উল্লেখ আছে, হাদিস টি – ক্বাইস ইবনে মাখরামা (রা.) তার পিতা হতে, তার পিতা তার দাদা হতে বর্ণনা করে বলেন, আমি ও রাসূল (সা.) হস্তির বছরে (আবরাহার বাহিনী ধ্বংসের বছর) জন্মগ্রহণ করি। তিনি বলেন, ইয়া‘মুর ইবনু লাইছ গোত্রীয় কুবাছ ইবনু আশইয়ামকে ওসমান ইবনু আফফান (রা.) প্রশ্ন করেন, আপনি বড় নাকি রাসূলুল্লাহ (সা.)? তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমার চাইতে অনেক বড়, তবে আমি তাঁর আগে জন্মগ্রহণ করি। রাসূলুল্লাহ (সা.) হাতির বছর জন্মগ্রহণ করেছেন। আমার মা আমাকে এমন জায়গায় নিয়ে গেলেন, যেখানে গিয়ে আমি পাখিগুলোর মলের রং সবুজে বদল হয়ে যেতে দেখেছি। আবু ঈসা (তিরমিযী) বলেন, এ হাদীসটি হাসান গরীব। আমরা শুধু মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক্বের সূত্রেই এ হাদীসটি জেনেছি। (জামে‘ আত-তিরমিযী, হা/৩৬১৯)
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কার অভ্যন্তরে হস্তিবাহিনীর বছর জন্মগ্রহণ করেন। (আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, ১/৭৬)।
এ যুগের জীবনীকার মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.) নবী (সা.) এর জন্ম তারিখ সম্পর্কে আরো ভিন্ন ভিন্ন মত তার গ্রন্থে গ্রহণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, এ বিষয়ে সবাই একমত যে নবী করিম (সা.) এর জন্ম রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার দিন হয়েছিল। কিন্তু তারিখ নির্বাচনে চারটি রেওয়ায়েত তথা বর্ণনা প্রসিদ্ধ রয়েছে। আর তা হলো রবিউল আউয়াল মাসের ২, ৮, ১০ ও ১২ তারিখ। তন্মধ্যে হাফিজ মুগলতাই (রহ.), সিরাতে মুগলতাই গ্রন্হে, ২ তারিখের রেওয়ায়েত গ্রহণ করে অন্য রেওয়ায়েতগুলোকে দুর্বল আখ্যা দিয়েছেন। তবে প্রসিদ্ধ হচ্ছে ১২ তারিখের রেওয়ায়েত।
হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) এই ১২ তারিখের রেওয়ায়েতে সবাই একমত বলে দাবি করেছেন। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা ইবনুল আসির তাঁর ‘আল কামিল ফিত তারিখ’ গ্রন্থে এ ১২ তারিখ কে গ্রহণ করেছে।
হুসাইন (রা.) এর পৌত্র মুহাম্মাদ ইবনে আলী আল-বাকের (১১৪ হি.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখ ১০ রবিউল আউয়াল। ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনে ওমর আল-ওয়াকেদী (২০৭ হি.) এই মত গ্রহণ করেছেন।
মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বাতে জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ ও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, ১৮ রবিউল আউয়াল রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখ । (আবুল ফিদা হাফিয ইমাদুদ্দীন ইবনে কাছীর, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
আরবের গবেষক সৌরবিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে ইবরাহীম লিখেছেন, বিশুদ্ধ রেওয়ায়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সা.) এর জন্ম হয় ২০ এপ্রিল ৫৭১খ্রিস্টাব্দ । সুতরাং তাঁর জন্ম-মৃত্যুর দিন খুব সূক্ষ্মভাবে বের করা সম্ভব এর ভিত্তিতে। বর্ণনার বিচারে ও যুক্তির আলোকে রাসূল (সা.) এর জন্ম তারিখ হলো ৯ রবিউল আউয়াল হিজরী পূর্ব ৫৩ সন মোতাবেক ২০ এপ্রিল, ৫৭১ খ্রিস্টাব্দ। (তাকবীমুল আযমান, পৃ. ১৪৩)।
এ ছাড়া সহীহ হাদীসসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল (সা.) এর জন্ম সোমবারে হয়েছে। কোন তারিখ সেটা বলা নেই। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে, ৮ হতে ১২ই রবিউল আউয়াল মধ্যে ৯ তারিখ ব্যতীত সোমবার ছিল না। অতএব রাসূল (সা.) এর সঠিক জন্ম দিবস ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার, ১২ই রবিউল আউয়াল বৃহস্পতিবার নয়। (সুলায়মান ইবনে সালমান মানছূরপুরী রহমাতুল্লিল আলামীন)
গবেষক মাহমুদ পাশা মিসরি জ্যোতিরবিজ্ঞানের মাধ্যমে ৯ তারিখ গ্রহণ করলেও তা সবার মতের বিপরীত ও সনদবিহীন উক্তি। যেহেতু চাঁদ উদয়ের স্থান বিভিন্ন, তাই গণনার ওপর এতটুকু বিশ্বাস ও নির্ভরতা জন্মায় না যে তার ওপর ভিত্তি করে সবার বিরোধিতা করা যাবে। সুতরাং এ ব্যাপারে এটা বলাই উত্তম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্ম তারিখ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ই ভালো জানেন। (আল্লাহু আলাম) ।