ঢাকা ০৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

চোখের জলে ভাসিয়ে দেওয়া বাংলার স্মৃতি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৩:৪৫:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ মে ২০২৪ ২৯ বার পড়া হয়েছে

 

স্মৃতি তুমি বেদনার,
আজিও কাঁদিছে হারানো স্বপন হৃদয়ের বেদিকায়>>>>>>>
ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়,
কলকাতা প্রতিনিধি
নাম ঋতম্ভরা  বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার এবং আমার বাবার স্বাধীনতার পর এপারে জন্ম হলেও আমার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে । এই সম্পর্ক বহু যুগের। আমার ঠাকুরদার চৌদ্দ পুরুষের বাস্তু ভিটে ছিল ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলার পাচ্চর বরমগঞ্জের কুমেরপাড় গ্রামে।
আমার ঠাকুমার জন্ম ঢাকা বিক্রমপুরের বাগড়া বাসুদেব বাড়িতে। ঠাকুমার মামা বাড়ি ছিল দিনাজপুরের শিবগঞ্জ এলাকায়। ঠাকুমার মামাতো বোনেরা  থাকতেন লাগোয়া ঠাকুর গাওতে। ঠাকুরমার মামাতো ভাই অজিতেশ ব্যানার্জি ওরফে ভুদুর ছিলেন সেই সময়ের সেরা ফুটবল প্লেয়ার।
দেশ ভাগের অনেক আগে ঠাকুরদা কলকাতার কাছে পানিহাটিতে বেঙ্গল কেমিক্যাল এ চাকুরীতে যোগদান করেন ১৯৪২ সালে। তারপর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সুপারিশে জলপাইগুড়ির চাবাগানে চাকুরি পেয়ে যান কলাবাড়ি চা বাগানের মালিক সত্যেন্দ্র প্রসাদ রায়ের দৌলতে।
ঠাকুরমাও মামা বাড়ি শিবগঞ্জ থেকে কলা বাড়িতে চলে আসেন ঠাকুরমার বাবার কাছে। ঠাকুরমার বাবা চা বাগানের অফিসার ছিলেন। কিছু কালের মধ্যে বাবা মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তখনও দেশ ভাগ হয়নি। প্রতিবছর কয়েকবার বাবা ঢাকা এবং ফরিদপুরে গেছেন গোয়ালন্দ ঘাট পেরিয়ে। কতো গল্প শুনেছি আমার বাবার কাছ থেকে। ঠাকুরদা নাকি বলতেন ”  চোর চোট্টা খেজুর গুড় তার নাম ফরিদপুর”। কতো বেদনাদায়ক সেই স্মৃতি। শুনলে আমারও চোখে জল চলে আসে।
ঠাকুরদার কাছে শোনা গল্প গুলি সেলুলয়েডের পর্দায় ঘুরে ফিরে আসছে। সবই বাবার কাছে শোনা।
কোলকাতা থেকে ট্রেনে করে গোয়ালন্দ ঘাটে পৌছুতেই সোরগোল পড়ে যেতো। ঘাটের সংলগ্ন খাবারের দোকানদারেরা ছুটোছুটি করতেন,এমন কি গায়ের জোড়ে হাত ধরে টেনে তাদের দোকানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেন, ,” আহেন কত্তা, পাকা পায়খানা, খাইবেন ভালো”। শুনেই ঠাকুরমা নাক কুঁচকে বলতেন, ” মাইগ্য মা কী সব বাজে কথা কইতাছে।  বাবা বলতেন দেরি কইরো না। তাড়াতাড়ি বসো।” সারা এলাকায় চিৎকারের ভরে উঠতো ।
সব দোকানেই ভাত ফুটছে, সব্জি গরম হচ্ছে, মাছের উৎপাদন টগবগ করছে। “আসেন বাবু, বইয়া পড়েন। কী খাইবেন তাড়াতাড়ি কন,স্টিমার ছাইড়া যাইবো”। যথারীতি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে ভাত, ডাল,সব্জি এলো। মাছ তখন ফুটছে। ডাল সব্জি খেতে খেতেই স্টিমারের হুইসেল বেজে উঠলো। চালু দোকানীরা পুরো টাকা আগেই নিয়ে নিয়েছে।
সব খদ্দের ছুটে চলেছেন স্টিমারের দিকে। ঠাকুরদা বললেন, অ্যাই মাছটা দেও। দোকানি বলতো,” “বাবু একটু বইতে হইবো। মাছ সিদ্ধ হইতাছে। ” আবার স্টিমারের ভেঁপু বেজে উঠলো। ঠাকুরদা ও ঠাকুমাকে নিয়ে ছুটলেন। দোকানি আর কাউকেই মাছ দিলো না।
ঘাট পেরিয়ে তারপর যখন ঢাকাতে পৌঁছলেন তখন খুব শান্তি পারেন।
ঠাকুরদা বলতেন, ঢাকাই কুট্টি দের কথা। ঘোড়ার গাড়ি দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ” নারায়নগঞ্জ যাইতে কত নিবা? টাঙ্গাওয়ালা বলেন, ” বাবু , আট আনা ভাড়া”। ঠাকুরদা বললেন,” চাইর আনায় যাইবা?” শুনেই কুট্টি গম্ভীর হয়ে ঠাকুরদার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,”” কত্তা আইস্তে কন, ঘোড়ায় হাসবো”।
আরেকবার ঠাকুরদা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। টাঙ্গাওয়ালাকে বিক্রমপুর যেতে ভাড়া জিজ্ঞাসা করতেই সে বলেছিল, আট আনা। ঠাকুরদা দরদাম করে ছয় আনা বলতেই,সেই কুট্টি টাঙ্গাওয়ালা বললেন,” হইবো ,তবে কত্তা আপনারে টাঙ্গার পিছে পিছে দৌড়াইতে হইবো। মালটা গাড়িতে রাইখতে পারবেন”। ঠাকুরদার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। আরেকবার বাজারে সব্জি কিনতে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতে দোকানি বলেছিলেন, “বাবু ২ আনা সের। ” ঠাকুরদা বেগুন তুলে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ” বেগুনে পোকা আছে মনে হচ্ছে।” দোকানি পাশের দোকানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” কাশেম হুনছস একজন বাইগনের ডাগডার আইছে। বাইগন তুইলাই কয় পোকা আছে “।
এমন অনেক অনেক মজার কথা শুনেছি,বাবা এবং ঠাকুরদার কাছে। মনটা ভরে ওঠে। চোখেও জল এসে যায়।
সত্যিই সোনার বাংলার নাম সার্থক ।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

চোখের জলে ভাসিয়ে দেওয়া বাংলার স্মৃতি

আপডেট সময় : ০৩:৪৫:২৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ মে ২০২৪

 

স্মৃতি তুমি বেদনার,
আজিও কাঁদিছে হারানো স্বপন হৃদয়ের বেদিকায়>>>>>>>
ঋতম্ভরা বন্দ্যোপাধ্যায়,
কলকাতা প্রতিনিধি
নাম ঋতম্ভরা  বন্দ্যোপাধ্যায়। আমার এবং আমার বাবার স্বাধীনতার পর এপারে জন্ম হলেও আমার আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে আজকের বাংলাদেশের সঙ্গে । এই সম্পর্ক বহু যুগের। আমার ঠাকুরদার চৌদ্দ পুরুষের বাস্তু ভিটে ছিল ফরিদপুরের মাদারীপুর জেলার পাচ্চর বরমগঞ্জের কুমেরপাড় গ্রামে।
আমার ঠাকুমার জন্ম ঢাকা বিক্রমপুরের বাগড়া বাসুদেব বাড়িতে। ঠাকুমার মামা বাড়ি ছিল দিনাজপুরের শিবগঞ্জ এলাকায়। ঠাকুমার মামাতো বোনেরা  থাকতেন লাগোয়া ঠাকুর গাওতে। ঠাকুরমার মামাতো ভাই অজিতেশ ব্যানার্জি ওরফে ভুদুর ছিলেন সেই সময়ের সেরা ফুটবল প্লেয়ার।
দেশ ভাগের অনেক আগে ঠাকুরদা কলকাতার কাছে পানিহাটিতে বেঙ্গল কেমিক্যাল এ চাকুরীতে যোগদান করেন ১৯৪২ সালে। তারপর আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সুপারিশে জলপাইগুড়ির চাবাগানে চাকুরি পেয়ে যান কলাবাড়ি চা বাগানের মালিক সত্যেন্দ্র প্রসাদ রায়ের দৌলতে।
ঠাকুরমাও মামা বাড়ি শিবগঞ্জ থেকে কলা বাড়িতে চলে আসেন ঠাকুরমার বাবার কাছে। ঠাকুরমার বাবা চা বাগানের অফিসার ছিলেন। কিছু কালের মধ্যে বাবা মায়ের বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু তখনও দেশ ভাগ হয়নি। প্রতিবছর কয়েকবার বাবা ঢাকা এবং ফরিদপুরে গেছেন গোয়ালন্দ ঘাট পেরিয়ে। কতো গল্প শুনেছি আমার বাবার কাছ থেকে। ঠাকুরদা নাকি বলতেন ”  চোর চোট্টা খেজুর গুড় তার নাম ফরিদপুর”। কতো বেদনাদায়ক সেই স্মৃতি। শুনলে আমারও চোখে জল চলে আসে।
ঠাকুরদার কাছে শোনা গল্প গুলি সেলুলয়েডের পর্দায় ঘুরে ফিরে আসছে। সবই বাবার কাছে শোনা।
কোলকাতা থেকে ট্রেনে করে গোয়ালন্দ ঘাটে পৌছুতেই সোরগোল পড়ে যেতো। ঘাটের সংলগ্ন খাবারের দোকানদারেরা ছুটোছুটি করতেন,এমন কি গায়ের জোড়ে হাত ধরে টেনে তাদের দোকানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতেন, ,” আহেন কত্তা, পাকা পায়খানা, খাইবেন ভালো”। শুনেই ঠাকুরমা নাক কুঁচকে বলতেন, ” মাইগ্য মা কী সব বাজে কথা কইতাছে।  বাবা বলতেন দেরি কইরো না। তাড়াতাড়ি বসো।” সারা এলাকায় চিৎকারের ভরে উঠতো ।
সব দোকানেই ভাত ফুটছে, সব্জি গরম হচ্ছে, মাছের উৎপাদন টগবগ করছে। “আসেন বাবু, বইয়া পড়েন। কী খাইবেন তাড়াতাড়ি কন,স্টিমার ছাইড়া যাইবো”। যথারীতি হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে ভাত, ডাল,সব্জি এলো। মাছ তখন ফুটছে। ডাল সব্জি খেতে খেতেই স্টিমারের হুইসেল বেজে উঠলো। চালু দোকানীরা পুরো টাকা আগেই নিয়ে নিয়েছে।
সব খদ্দের ছুটে চলেছেন স্টিমারের দিকে। ঠাকুরদা বললেন, অ্যাই মাছটা দেও। দোকানি বলতো,” “বাবু একটু বইতে হইবো। মাছ সিদ্ধ হইতাছে। ” আবার স্টিমারের ভেঁপু বেজে উঠলো। ঠাকুরদা ও ঠাকুমাকে নিয়ে ছুটলেন। দোকানি আর কাউকেই মাছ দিলো না।
ঘাট পেরিয়ে তারপর যখন ঢাকাতে পৌঁছলেন তখন খুব শান্তি পারেন।
ঠাকুরদা বলতেন, ঢাকাই কুট্টি দের কথা। ঘোড়ার গাড়ি দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ” নারায়নগঞ্জ যাইতে কত নিবা? টাঙ্গাওয়ালা বলেন, ” বাবু , আট আনা ভাড়া”। ঠাকুরদা বললেন,” চাইর আনায় যাইবা?” শুনেই কুট্টি গম্ভীর হয়ে ঠাকুরদার কানের কাছে মুখ এনে বললেন,”” কত্তা আইস্তে কন, ঘোড়ায় হাসবো”।
আরেকবার ঠাকুরদা এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন। টাঙ্গাওয়ালাকে বিক্রমপুর যেতে ভাড়া জিজ্ঞাসা করতেই সে বলেছিল, আট আনা। ঠাকুরদা দরদাম করে ছয় আনা বলতেই,সেই কুট্টি টাঙ্গাওয়ালা বললেন,” হইবো ,তবে কত্তা আপনারে টাঙ্গার পিছে পিছে দৌড়াইতে হইবো। মালটা গাড়িতে রাইখতে পারবেন”। ঠাকুরদার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিল। আরেকবার বাজারে সব্জি কিনতে গিয়ে দাম জিজ্ঞেস করতে দোকানি বলেছিলেন, “বাবু ২ আনা সের। ” ঠাকুরদা বেগুন তুলে নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ” বেগুনে পোকা আছে মনে হচ্ছে।” দোকানি পাশের দোকানের দিকে তাকিয়ে বলে, ” কাশেম হুনছস একজন বাইগনের ডাগডার আইছে। বাইগন তুইলাই কয় পোকা আছে “।
এমন অনেক অনেক মজার কথা শুনেছি,বাবা এবং ঠাকুরদার কাছে। মনটা ভরে ওঠে। চোখেও জল এসে যায়।
সত্যিই সোনার বাংলার নাম সার্থক ।