পুণ্যময় রজনী শবে কদরের গুরুত্ব ও ফজিলত

- আপডেট সময়- ০১:৫৬:০৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫ ২০ বার পড়া হয়েছে

ফেরদৌস আলম,বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি, রাজশাহী।।
শবে কদর বা লাইলাতুল কদর ইসলামের সবচেয়ে মহিমান্বিত ও পুণ্যময় রাতগুলোর মধ্যে একটি। এই রাতের মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা নিজেই কোরআনে বর্ণনা করেছেন, যা মানবজাতির জন্য এক অপার রহমত ও বরকতের বার্তা বহন করে। শবে কদরের রাত শুধুমাত্র একটি রাতই নয়, বরং এটি মুমিন বান্দাদের জন্য আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত ও ক্ষমার সুযোগ। এই রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত থেকেও উত্তম, যা মুমিনদের জীবনে নতুন প্রেরণা ও শক্তি যোগায়।
কোরআনের আলোকে শবে কদরের মর্যাদা:
ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ কোরআন আলোকে শবে কদর বা লাইলাতুল কদর একটি অতুলনীয় ও মহিমান্বিত রজনী।কোরআনে শবে কদরের বিশেষ মর্যাদা ও ফজিলত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নে কোরআনের বিভিন্ন সূরায় শবে কদরের বর্ণনা উল্লেখ করা হলো:
১. সূরা আল-কদর:
সূরা আল-কদরে আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আপনি কি জানেন, কদরের রাত কি? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক কাজে অবতীর্ণ হন। এ রাত পুরোপুরি শান্তিময়, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।” (সূরা আল-কদর, ৯৭:১-৫)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, শবে কদরের রাত হাজার মাসের ইবাদত থেকেও উত্তম। এই রাতে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক। এই রাতের বিশেষত্ব হলো, এতে ফেরেশতারা পৃথিবীতে অবতরণ করেন এবং আল্লাহর রহমত ও বরকত বর্ষিত হয়।
২. সূরা আদ-দুখান:
সূরা আদ-দুখানে আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয়ই আমি এটি (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি এক মুবারক পূর্ণ রাতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।” (সূরা আদ-দুখান, ৪৪:৩-৪)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, শবে কদরের রাত একটি মুবারক পূর্ণ (বরকতময়) রাত। এই রাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর সকল প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থির করেন। এই রাতেই ভাগ্য নির্ধারণ করা হয় এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য বিশেষ রহমত ও বরকত নাজিল হয়।
৩. সূরা আল-বাকারাহ:
সূরা আল-বাকারাহতে আল্লাহ তাআলা বলেন: “রমজান মাস, যাতে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা মানুষের জন্য হিদায়াত এবং সত্যপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন।” (সূরা আল-বাকারাহ, ২:১৮৫)
এই আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, রমজান মাসে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক। শবে কদরের রাতেই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, যা এই মাসের বিশেষ মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়।
হাদিসে শবে কদরের ফজিলত:
হাদিস শরিফেও শবে কদরের বিশেষ ফজিলত ও মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নে বোখারী, মুসলিম, সিয়াসেত্তাহ গন্হের হাদিসগুলো উল্লেখ করা হলো:
১. সহিহ বুখারি:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সওয়াবের আশায় কদরের রাতে ইবাদত করে, তার পূর্ববর্তী সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। সহিহ বুখারি, হাদিস নং ” (১৯০১)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, শবে কদরের রাত মুমিনদের জন্য আল্লাহর ক্ষমা ও রহমত লাভের এক অনন্য সুযোগ।
২. সহিহ মুসলিম:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত তালাশ করো।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ১১৬৭)
৩. সুনান আবু দাউদ:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “কদরের রাত হলো রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে।” (সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং ১৩৭৬)
৪. সুনান তিরমিজি:
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “কদরের রাতের লক্ষণ হলো, এ রাত অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও নির্মল হয়।” (সুনান তিরমিজি, হাদিস নং ৭৯১)
শবে কদরের রাতে ভাগ্য নির্ধারণ:
শবে কদরের রাতে ভাগ্য নির্ধারণ হয় কিনা এ বিষয়ে ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। সূরা আদ-দুখানের ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে: “এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়।”
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, শবে কদরের রাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর সকল প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থির করেন। তবে এ বিষয়ে আলেমগণের মধ্যে দুটি মত রয়েছে:
১. প্রথম মত: শবে কদরের রাতে পুরো বছরের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়।
২. দ্বিতীয় মত: শবে কদরের রাতে শুধুমাত্র ঐ বছরের রমজান মাসের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়।
ফকিহবিদ ও তাবে তাবেঈনের ব্যাখ্যা:
ইসলামিক ফকিহবিদ ও তাবে তাবেঈনগণ শবে কদরের রাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন।
১ . ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, “কদরের রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত থেকে উত্তম। এই রাতে ইবাদত করলে আল্লাহ বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন।”
২. ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) বলেছেন, “কদরের রাত হলো আল্লাহর বিশেষ রহমতের রাত। এই রাতে ইবাদত করলে বান্দার ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি পায়।”
৩. ইবনে তাইমিয়া (রহ.) বলেছেন, “কদরের রাতের ইবাদত হলো আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বোত্তম উপায়। এই রাতে ইবাদত করলে বান্দার ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি পায়।”
৪. আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) তার তাফসিরে উল্লেখ করেছেন, “কদরের রাত হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য একটি বিশেষ উপহার। এই রাতে ইবাদত করলে বান্দার জীবনে শান্তি ও বরকত নেমে আসে।”
৫. আল্লামা দায়ী (রহ.) বলেছেন, “কদরের রাত হলো আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের রাত। এই রাতে ইবাদত করলে বান্দার গুনাহ মাফ হয় এবং তার আধ্যাত্মিক মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।”
শবে কদরের দিন-তারিখ:
শবে কদরের সঠিক তারিখ সম্পর্কে হাদিসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “তোমরা রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত তালাশ করো।” (সহিহ বুখারি, হাদিস নং ২০২১)
এই হাদিস অনুযায়ী, শবে কদর রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে (২১, ২৩, ২৫, ২৭, ২৯ তারিখে) অনুসন্ধান করা উচিত। তবে অধিকাংশ আলেমগণের মতে, ২৭ রমজানের রাতেই শবে কদর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
শবে কদরের আমল:
শবে কদরের রাতে নিম্নলিখিত আমলগুলো করা উচিত:
১. নামাজ: নফল নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ ও তারাবিহ নামাজ পড়া।
২. কোরআন তিলাওয়াত: এই রাতে কোরআন তিলাওয়াত করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।
৩. দোয়া: এই রাতে বেশি বেশি দোয়া করা উচিত।
বিশেষ করে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত দোয়া: “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফ
“আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাফু আন্নি।” (হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে পছন্দ করেন, তাই আমাকে ক্ষমা করুন।)
৪. জিকির: আল্লাহর জিকির ও তাসবিহ পাঠ করা।
৫. ইস্তিগফার: গুনাহ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করা।
শবে কদরের রাতের লক্ষণ:
কদরের রাতের কিছু লক্ষণ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:
– এই রাত অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও নির্মল হয়।
– এই রাতের আকাশ পরিষ্কার ও উজ্জ্বল হয়।
– সকালে সূর্য উদয় হয় নরম আলো নিয়ে, যেন চাঁদের মতো।
শবে কদরের রাত আমাদের জীবনের গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের এক অনন্য সুযোগ। এই রাত মুমিনদের জন্য একটি বিশেষ উপহার। এই রাতের বরকত ও রহমত লাভের মাধ্যমে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনকে আরও উন্নত ও পরিশুদ্ধ করতে পারি। তাই আমাদের উচিত এই রাতকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে পালন করা এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা।
নিউজটি শেয়ার করুন

-
সর্বশেষ সংবাদ
-
জনপ্রিয় সংবাদ