ফেরদৌস আলম।।
শবে মেরাজ ইসলাম ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাত, যা মুসলমানদের জন্য বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এই রাতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মুসলমানদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান প্রাপ্ত হন। শবে মেরাজের ঘটনাটি কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত রয়েছে এবং এটি মুসলমানদের জন্য একটি মহান শিক্ষা ও প্রেরণার উৎস।
শবে মিরাজ কী:
শবে মিরাজ, যার আরবি হলো ‘লাইলাতুল মিরাজ’। মিরাজ অর্থ ঊর্ধ্বারোহণ। শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ অর্থ হলো ঊর্ধ্বগমনের রজনী। রাসুল (সা.) যে রাতে আল্লাহ তাআলার ডাকে সাড়া দিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছিলেন, সেই রাত ও সেই পবিত্র অভিযাত্রাকে শবে মিরাজ বা লাইলাতুল মিরাজ বলা হয়।
শবে মেরাজের ইতিহাস:
শবে মেরাজ ৬২১ খ্রিস্টাব্দে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ৫০ বছর বয়সে নবুয়তের দশম বর্ষে রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রজনীতে সংঘটিত হয়েছিল। ওই রাতে তিনি কাবা শরিফের চত্বরে (হাতিমে) অথবা কারও মতে, উম্মে হানির গৃহে শায়িত ও নিদ্রিত ছিলেন।
এমন সময় ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) সেখানে এসে তাঁকে ঘুম থেকে জাগালেন, অজু করালেন, সিনা চাক করলেন এবং ‘বোরাকে’ চড়িয়ে মুহূর্তের মধ্যে বায়তুল মোকাদ্দাস পৌঁছালেন। সেখানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ‘ইমামুল মুরসালিন’ হিসেবে সব নবী-রাসুলের ইমামতিতে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করলেন।
এরপর তিনি আবার বোরাকে চড়ে সপ্তাকাশ পরিভ্রমণ করলেন এবং সেখান থেকে সপ্তম আকাশের ওপর ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ নামক স্থানে পৌঁছালেন, যেখানে ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.) থেমে গেলেন এবং নবী করিম (সা.) একাকী ‘রফরফে’ চড়ে ‘বায়তুল মামুরে’ উপনীত হলেন।
এরপর নবী করিম (সা.) রফরফে চড়ে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হন। তিনি এখানে শুধু একটি পর্দার অন্তরাল থেকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করলেন। সেখানে তিনি প্রভুর সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হন। আশেক ও মাশুকের মধ্যে সংলাপ ও কথোপকথন হলো। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের বিশেষ রহস্য বুঝিয়ে দিলেন এবং জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করালেন।
এই সফরের সময় তিনি বিভিন্ন আসমানি স্তর অতিক্রম করেন এবং প্রতিটি স্তরে নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সর্বশেষে তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছান, যেখানে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের বিধান লাভ করেন।
মেরাজ সফরে যাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়:
প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), দ্বিতীয় আসমানে হজরত ইয়াহইয়া (আ.) ও হজরত ঈসা (আ.), তৃতীয় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), চতুর্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), পঞ্চম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ষষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), সপ্তম আসমানে হজরত ইবরাহিম (আ.)।
প্রত্যেকের সঙ্গে সালাম, কালাম ও কুশল বিনিময় হয়েছে। তিনি বায়তুল মামুর গেলেন, যেখানে প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা আসেন ও প্রস্থান করেন; তাঁরা দ্বিতীয়বার আসার সুযোগ পান না। অতঃপর সিদরাতুল মুনতাহার কাছে গেলেন। সেখানে চারটি নদী দেখলেন; দুটি প্রকাশ্য ও দুটি অপ্রকাশ্য।
অপ্রকাশ্য দুটি নদী জান্নাতের আর প্রকাশ্য নদী দুটি হলো নীল ও ফোরাত। তারপর বায়তুল মামুরে পৌঁছালে এক পেয়ালা শরাব, এক পেয়ালা দুধ ও এক পেয়ালা মধু পেশ করা হলো। তিনি (সা.) দুধ পান করলেন, এটাই স্বভাবসুলভ (ইসলাম)। (বুখারি শরিফ: ৩৬৭৪)
কুরআনে শবে মেরাজ:
শবে মেরাজের ঘটনা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। সূরা ইসরায় এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: পবিত্র ও মহীয়ান তিনি; যিনি তাঁর বান্দা কে রাতের বেলা ভ্রমণ করিয়েছেন মাসজিদুল হারাম থেকে মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার চারপাশকে আমি কল্যাণময়/বরকতময় করেছি। তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।
এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে শবে মেরাজের ঘটনাকে নির্দেশ করে এবং আল্লাহর মহান ক্ষমতার পরিচয় দেয়।
হাদীসে শবে মেরাজ:
হাদীসে শবে মেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। নবী (সা.) বলেছেন: আমার প্রতি যেদিন মেরাজ নাযিল হয়েছিল, সেদিন আল্লাহ আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী)
এটি প্রমাণ করে যে, নামাজ ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ এবং শবে মেরাজের মাধ্যমে এটি মুসলমানদের জন্য ফরজ করা হয়েছে।
শবে মেরাজের দিন তারিখ:
শবে মেরাজের দিন তারিখ নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। সাধারণভাবে, এটি রজব মাসের ২৭ তারিখে পালিত হয়। ইসলামী স্কলারদের মধ্যে অনেকেই এই তারিখকে শবে মেরাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে কিছু স্কলার মনে করেন যে, এটি অন্য কোনও তারিখেও হতে পারে। তাদের মতে, সঠিক তারিখ নির্ধারণ করা কঠিন, কারণ এটি একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা এবং এর সঠিক তারিখ কুরআন বা হাদীসে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি।
মিরাজের উপহার:
বিশিষ্ট সাহাবি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লেখ আছে যে, মিরাজের রজনীতে নবী করিম (সা.) এবং তাঁর উম্মতের জন্য কয়েকটি জিনিস প্রদান করা হয়: ১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যা প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত ছিল। ২. তাঁর উম্মতদের মধ্যে যাঁরা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, আল্লাহ তাঁর পাপ ক্ষমা করে দেবেন। ৩. সুরা আল-বাকারার শেষাংশ। ৪. সুরা বনি ইসরাইলের ১৪ দফা নির্দেশনা।
সুরা বনি ইসরাইলের নির্দেশনাগুলো হলো:
১. আল্লাহকে ছাড়া কারও ইবাদত করবে না। ২. পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। ৩. স্বজনদের অধিকার দেবে। ৪. দরিদ্র ও পথসন্তানদের অধিকার দেবে। ৫. অপচয় করবে না। ৬. কৃপণতাও করবে না। ৭. সন্তানদের হত্যা করবে না। ৮. ব্যভিচারী হবে না। ৯. মানুষকে কখনোই হত্যা করবে না। ১০. পিতৃমাতৃহীনদের সম্পদ কেড়ে নিও না। ১১. প্রতিশ্রুতি পূর্ণ কোরো। ১২. মাপে পূর্ণভাবে দেবে। ১৩. যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, তা অনুসন্ধান করো। ১৪. অহংকার কোরো না।
মেরাজ উদযাপনের পদ্ধতি:
শবে মেরাজ পালনের পদ্ধতি বিভিন্নভাবে হয়ে থাকে, যা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে। এখানে কিছু সাধারণ পদ্ধতি উল্লেখ করা হলো:
নফল নামাজ: মুসলমানরা এই রাতে অতিরিক্ত নফল নামাজ আদায় করে থাকেন। বিশেষ করে রাতের শেষ অংশে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়া হয়।
কুরআন তিলাওয়াত: শবে মেরাজের রাতে কুরআন তিলাওয়াত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। অনেক মুসলমান এ রাতে বিশেষ করে সূরা ইসরা ও সূরা নিসা তিলাওয়াত করেন।
দুয়া ও জিকির: এই রাতে আল্লাহর কাছে দুয়া করা এবং জিকির করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমানরা নিজেদের জন্য, পরিবার এবং উম্মাহর জন্য বিশেষভাবে দুয়া করেন।
সেহরি: অনেক মুসলমান শবে মেরাজ উপলক্ষে রাতভর ইবাদত করে সেহরি খেয়ে সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।
মিলাদ মাহফিল: কিছু অঞ্চলে মুসলমানরা শবে মেরাজ উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল আয়োজন করে থাকেন। এই মাহফিলে নবী (সা.) এর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়।
শবে মেরাজের শিক্ষা:
শবে মেরাজ মুসলমানদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করে:
নামাজের গুরুত্ব: নামাজ ইসলামের প্রধান স্তম্ভ। শবে মেরাজের মাধ্যমে নামাজ ফরজ করা হয়েছে, যা মুসলমানদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ।
আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস: মহানবী (সা.) আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা মুসলমানদের মধ্যে আল্লাহর প্রতি গভীর বিশ্বাস ও আস্থা সৃষ্টি করে।
নবীদের সম্মান: শবে মেরাজে নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ মুসলমানদের নবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের শিক্ষা দেয়।
আধ্যাত্মিক উন্নয়ন: এই রাতটি মুসলমানদের জন্য আধ্যাত্মিক উন্নয়নের একটি সুযোগ। বিশেষত, রাতটি ইবাদত-বন্দেগিতে কাটানো উচিত।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্য: শবে মেরাজ মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির বার্তা দেয়। সকল মুসলমানকে একত্রিত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে উদ্বুদ্ধ করে।
শবে মেরাজ মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ রাত। এটি আমাদেরকে নামাজের গুরুত্ব, আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস এবং নবীদের সম্মানের শিক্ষা দেয়। এই রাতে ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে আমরা আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নয়ন ঘটাতে পারি এবং আল্লাহর কাছ থেকে রহমত লাভ করতে পারি। তাই, শবে মেরাজকে আমাদের জীবনে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করা উচিত এবং এর শিক্ষা অনুযায়ী চলার চেষ্টা করা উচিত।
শবে মেরাজ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা যদি আল্লাহর পথে চলতে চাই, তাহলে আমাদের অবশ্যই নিয়মিত নামাজ আদায় করতে হবে এবং আমাদের জীবনকে ইসলামের নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে।
◑ Chief Adviser ☞ ◑ Adviser☞ Mohammad Kamrul Islam
◑Editor & publisher ☞ Mohammad Islam ✪Head office:-Motijheel C/A, Dhaka-1212,
✪Corporate office:-B.B Road ,Chasara, Narayanganj-1400, ✆Tell-02-47650077,02-2244272 Cell:+88-01885-000126
◑web:www.samakalinkagoj.com. ✪For news:(Online & Print)samakalinkagojnews@gmail.com,
✪For advertisements:-ads.samakalinkagoj@gmail.com✪For Editor & publisher:-editorsamakalinkagoj@gmail.com.✆Cell: +8801754-605090(Editor)☞Instagram.com/samakalinkagoj ☞ twitter.com/samakalinkagoj
☞সম্পাদক ও প্রকাশক কর্তৃক ১৮০,ফকিরাপুল পানির টাংকির গলি,মতিঝিল বা/এ, ঢাকা অবস্থিত 'জননী প্রিন্টার্স' ছাপাখানা হতে মুদ্রিত, ✪ রেজি ডি/এ নং-৬৭৭৭
◑ All Rights Reserved ©Daily samakalin kagoj paper authority>(© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ©দৈনিক সমকালীন কাগজ পত্রিকা কর্তৃপক্ষ)
Copyright © 2025 Daily Samakalin Kagoj. All rights reserved.