ভারতের দুই মহান ব্যক্তির কাছ থেকেও কোন বর্তমান রাজনীতিবিদ শিক্ষা লাভ করলেন না। প্রথম জন প্রয়াত প্রধান মন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী, দ্বিতীয় জন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম আজাদ।লালবাহাদুর শাস্ত্রীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর কোন ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল না।
তিনি যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন তখন তার মাএকটি অজ গ্রামের স্টেশনে পুরো একটি দিন প্লাটফর্মে শুয়ে কাটালেন। পরবর্তী ট্রেন ২৪ ঘণ্টা পরে ছাড়ার কথা।তার পুত্র কী করেন তিনি জানতেন না। এক কুলি তাকে পুত্রের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি লাল বাহাদুর শাস্ত্রী বলেছিলেন। ব্যস, সারা স্টেশনে হুলুস্থুল। বিশেষ সেলুনে বসিয়ে তাকে দিল্লি পাঠানো হলে পুত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, " হ্যাঁরে ,তুই কী চাকরি করিস রেলে?" উত্তরে শাস্ত্রীজী বলেছিলেন " সামান্য একটা কাজ".
লালবাহাদুরের দুই পুত্র অনিল এবং সুনীল যথাক্রমে কংগ্রেস এবং বিজেপির মুখপাত্র ছিলেন। আমার সঙ্গে গাভীর আন্তরিকতা ও ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ছিল,বিশেষ করে সুনীল শাস্ত্রীর। একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকতেন। মাঝে মাঝেই পায়ে হেঁটে দুজনেই ২৪ আকবর রোডে এবং ১১ অশোকা রোডের অফিসে আসতেন। পরবর্তীকালে পার্টি অফিস থেকে আসা যাওয়ার জন্য গাড়ি দেওয়া হয়েছিল।
দ্বিতীয় জন, বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ২০০২ সালে যখন রাষ্ট্রপতি ভবনে এলেন,সেদিন একটি হলুদ ট্যাক্সি থেকে নেমে ভবনে প্রবেশ করেন। সঙ্গে ছিল মাত্র একটি ট্রাংক ও একটি ব্রিফকেস। ট্র্যাংকটি পুরো বই ও কাগজপত্রে ঠাসা। পূর্বে পরিচয় সূত্রে সেদিন গিয়েছিলাম সেখানে। একগাল হাসি নিয়ে ব্রিফকেস হাতে এগিয়ে যাওয়ার আগেই রাষ্ট্রপতি ভবনের কর্মীরা সেগুলি কেড়ে নিয়ে তার কামরার দিয়ে নিয়ে গেলেন।।j
২০০৭ সালে যেদিন বিদায় নিলেন তখন সরকার থেকে একটি প্রাইভেট কার ও তার পাওনা মালপত্র নিয়ে যাবার জন্য তিনটি ট্রাক দেওয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়েই তিনি অফিসারদের ডেকে ট্রাক তিনটি ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিলেন। তারা তো অবাক! এতো মালপত্র যাবে কীকরে!!!
কালাম বললেন,তার তো মাত্র একটি ট্রাঙ্ক ও একটি ব্রিফকেস রয়েছে। বাকি সমস্ত মাল তার নয়। রাষ্ট্রপতি থাকা কালীন দেশ বিদেশ থেকে তাকে অফুরন্ত উপহার দেওয়া হয়েছে,কিন্তু সেগুলি দেওয়া হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে। সেই সম্পদ ভারতের। আমার নয়। এই বলে তিনি সটান প্রাইভেট গাড়িতে উঠে পড়লেন নিজের ট্রাঙ্ক ও একটি ব্রিফকেস নিয়ে। ইনি হলেন সেই এপিজে আবদুল কালাম।
এরা হলেন প্রকৃত সততা ও গণতন্ত্রের প্রতীক।কোন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী এদের কাছ থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ করলেন না।।
ঠিক এর আগে রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলকে দেখেছি। যখন এলেন,একটি প্রাইভেট কারে। যাবার সময় দুটি ট্রাক বোঝাই মাল নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন ছেড়ে চলে গেলেন।
এই প্রতিভা পাতিলই হয়ে গেলেন সকলের অনুকরণীয়। বিহারের লালু প্রসাদ যাদব যখন রেলমন্ত্রী ছিলেন, সারা রেলের সম্পত্তিই হয়ে গেল তার বাপের সম্পত্তি। এমনকি রেল লাইনের ধারে রেলের জমি গুলিও রক্ষা পেলো না। সেগুলিও জলের দরে বিক্রি করে দিলেন পরিচিত এবং আত্মীয় স্বজনের কাছে।
তারপর থেকে অনবরত চলেছে লুট,আত্মসাতের ঘটনা।
ওড়িশার প্রাক্তন সাংসদ আচারিয়া প্রসন্ন পাতসানি পরপর তিনবার সাংসদ হলেন ভোটে জিতে। নির্বাচনে তার খরচ হয়েছিল মাত্র ৫ হাজার টাকা করে। বিশাল লোকসভা কেন্দ্রের আনাচে কানাচে পায়ে হেঁটে প্রচার করতেন। কোন হোর্ডিং,ফেস্টুন ছাপেন নি। কিছু ভক্ত নিজের টাকায় কিছু লিফলেট ছেপে ছিলেন। জনতা তার নামেই ভোট দিয়েছেন। বারবার জিতে এসেছেন। দিল্লিতে তার সরকারি ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেছি তিনি মাটিতে চাদর বিছিয়ে শুয়ে রয়েছেন। দেখা হতেই উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানান। অনেক গল্প হতো। এক কাপ চা,সঙ্গে দুটি বিস্কুট খেতাম। বাইরে লনে বসে জাম গাছের দিকে তাকিয়ে কর্মীকে জাম আনতে বলতেন। একবাটি জাম খেতেন। এটাই নাকি তার জল খাবার। বিশ্বের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক আসতো বিভিন্ন বিষয়ে বক্তৃতা দেবার জন্য। দীর্ঘ একদশক পরেও দেখেছি সেই একই অবস্থা!! এমন মানুষ কজন হয়? পরে কিন্তু পার্টি থেকে তাকে নির্বাচনে লড়াই করার টিকিটই দেওয়া হয় নি। অথচ তিনি ছিলেন গণতন্ত্রের পূজারী। যেখানে ভোট জিততে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয় প্রার্থীকে, পার্টি থেকে বিভিন্ন লোভ দেখিয়ে, বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, ব্যালট বাক্স তুলে নিয়ে ,বুথ দখল করে গণতন্ত্রের হত্যা হয়,সেখানে প্রসন্ন পাতাসনি খালি পায়ে হেঁটে প্রচার করতেন কোন প্রচার সামগ্রী ছাড়াই। এদের অনুকরণ কেউ করেনি। গণতন্ত্রের ধ্বংস হচ্ছে জেনেও ভোটাররাও ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বসে পড়েছে।
অযোগ্য প্রার্থী জিতে সংসদে যাচ্ছেন। কেউ গুণ্ডামী করে,যে সিনেমার নায়ক,নায়িকার তকমা নিয়ে। এই সাংসদরা পার্লামেন্টে গিয়ে কি অভিনয় করবেন,নাকি গুন্ডামি করবেন!!!
জনতা যেখানে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বসে আছেন সেখানে তাদের অপকীর্তির জোরে জিতে আসা সাংসদরা কী পাবেন?
মাসে মাসে ৮০ হাজার টাকা বেতন। সংসদে দৈনিক হাজিরার জন্য দৈনিক ২ হাজার টাকা, বিশাল বাংলো। সবকিছুই বিলাসিতায় ভরা। টেলিফোন ফ্রি। বিদ্যুৎ , জল ফ্রি। অফিসের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা। যাতায়াতের জন্য গাড়ি। পেট্রোল ফ্রি। ট্রেন সফর দলবল সহ ফ্রি। বছরে ৩৮ বার ফ্রিতে সঙ্গী নিয়ে বিমান সফর। এছাড়াও রয়েছে আরও অনেক সুবিধা। পার্লামেন্টে মাত্র ৩০ টাকায় আমিষ খাদ্য। চামচা ও সুবিধাবাদীদের কাছ থেকে মূল্যবান উপহার।
এই মহা বৈভবের ও বিলাসিতার জীবন তাদের দিতে গিয়ে যারা নিজের মানুষের মাথা ভাঙলেন, বাড়ি ভেঙে জ্বালিয়ে দিলেন,বোমা বিস্ফোরণ ঘটালেন তারা কী পেলেন? এক কান্দি কাঁচা কলা। এই কি গণতন্ত্র??